ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন অর্গানোগ্রাম নিয়ে এবার বিপাকে বিমান

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৮ অক্টোবর ২০১৮

 নতুন অর্গানোগ্রাম নিয়ে এবার বিপাকে বিমান

আজাদ সুলায়মান ॥ বারো শ’ কোটি টাকার একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের চার পাশে কাজ করে চারশ’ টাকা বেতনের দৈনিক ভিত্তিক নবীন শ্রমিক। জীবনে কোনদিন বিমানবন্দর দেখেনি, এমন আনাড়ি চালককে দিয়েও কাজ করানো হচ্ছে মূল্যবান এসব উড়োজাহাজে। পরিণতিতে মাসুল দিতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা মূল্যের উড়োজাহাজকে। প্রায়ই এটা-ওটা ভেঙ্গে চুরমার। সর্বশেষ গত মাসেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নভো এয়ারের একটি ড্যাশ-৮ এর জানালা ভেঙ্গেছে বিমানের দৈনিক ভিত্তিক এক নবীন চালক। এতে গ্রাউন্ডেড হয়েছে ওই এয়ারক্রাফট। বিমানেএমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে ২২ শ’ ক্যাজুয়াল শ্রমিক দিয়ে, যাদের ঠাঁই মেলেনি সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত অর্গানোগ্রামে। তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে প্রত্যক্ষভাবেই। এ অর্গানোগ্রামকে অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলে দাবি করছে এসব ক্যাজুয়াল শ্রমিক। বিক্ষুব্ধ এই শ্রমিকরা বলাকা ঘেরাওয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন ‘আগামী পর্ষদ সভায় এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।’ কার্যত এই অর্গানোগ্রাম নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিমান। প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের এক সপ্তাহের মাথায় ম্যানেজমেন্টকে এ ধরনের বৈরী পরিবেশের মুখে নতি স্বীকার করায় বিমানের নীতি নির্ধারকদের যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব ও দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের এমডি ও চেয়ারম্যান কেউই তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাননি। তারাও এতে বিব্রত। আর ম্যানেজমেন্টের এমন দুর্বলতা কড়ায় গ-ায় কাজে লাগিয়েছে ২২ শ’ ক্যাজুয়াল শ্রমিক। গত সপ্তাহের বিমানের সদর দফতর বলাকা ঘেরাওয়ের দিন ম্যানেজমেন্টের নতি স্বীকারের ঘটনায় এসব শ্রমিক এখন আরও উজ্জীবিত ও সুসংহত। তাদের নেতা হানিফ এখন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই নিশ্চয়তা দিচ্ছেন- এবারের আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য এসে গেছে। অপেক্ষা আগামী পর্ষদ সভা পর্যন্ত। সে পর্যন্তই শ্রমিকরা চুপ। যদি ওই বৈঠকেও কিছু না হয়-তাহলে এ আন্দোলনে যোগ দেবে বিমানের বর্তমান সিবিএ। কারণ এর ওপর নির্ভর করছে সিবিএ সভাপতি ও বিমান শ্রমিক লীগ নেতা মশিকুর রহমানের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যত। এ বিবেচনায় এটা তার জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিমানের ৭০০ ক্যাজুয়াল পে গ্রুপ (৩/১) ও (৩/২) তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা চাকরি স্থায়ীকরণের বিধান রেখে অনুমোদন দেয়া হয় নতুন অর্গানোগ্রামের। যেখানে পে গ্রুপ-১ এ ক্যাটাগরিতে একজন শ্রমিককেও রাখা হয়নি। যার খাস বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়, বিমানের একজন শ্রমিকও স্থায়ী থাকবে না। এই গ্রুপের সব পদই পূরণ করা হবে আউট সোর্সিং করে। ওই অর্গানোগ্রাম বিশ্লেষণ করে বিমানের সাবেক এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, এমন বিতর্কিত অর্গানোগ্রাম যারা অনুমোদন করেছেন, হয় তাদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই, নয় তারা অত্যন্ত ঠা-া মাথায় বিমানের সর্বনাশ করার মানসিকতায় এই অর্গানোগ্রামে অনুমোদন করেছেন। কেননা বিমান বর্তমানে চলছে ৭৯ সালের অর্গানোগ্রাম দ্বারা- যা ২০০৭ সালে কিঞ্চিত রিভিউ করা হয়, শুধুমাত্র জনবল কমানোর জন্য। ফলে গত কয়েক বছর ধরেই একটি যুগোপযোগী ও শিল্পবান্ধব অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) প্রণয়নের জন্য দাবি ওঠে। মাঝে একবার ২০১২ সালে সোয়া এক কোটি টাকা ব্যয়ে একটা অর্গানোগ্রাম করা হয় যা কখনই বিমানের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এরপর গত ৫ বছর ধরেই এজন্য একের পর এক বৈঠকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ চলে অর্গানোগ্রামে। এতে সবার মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল- এবার হয়তো একটা মানসম্মত ও বাস্তবমুখী একটা অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হবে। কিন্তু এটা প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, এতে এই ২২ শ’ শ্রমিককে ক্ষুব্ধই করেনি-প্রশ্নও ওঠেছে ওই কমিটির নীতি নির্ধারকদের যোগ্যতা নিয়েও। কেননা বিমানের মতো একটা এয়ারলাইন্সে পে-গ্রুপ-১ এ একটি পদও রাখা হয়নি। অথচ বিমান অপারেশনের ৮০ ভাগই কাজ নির্ভর করেই এই গ্রুপের দুই সহস্রাধিক শ্রমিকের ঘাম, মেধা ও শ্রমের ওপর। এ প্রসঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে জানান, প্রস্তাবিত এই অর্গানোগ্রামে পিরামিড তত্ত্বের দোহাই দেয়া হয়েছে। অথচ পিরামিড তত্ত্বটাই (হাইয়ারারসি) হচ্ছে নিচের দিক থেকে ওপরের জনবল কাঠামো পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। যেই প্রতিষ্ঠানে নিচের দিকে জনবল যতটা শক্ত, সেই প্রতিষ্ঠানের পিরামিড তত্ত্বের অবস্থানও ততো বেশি কার্যকর। বিমানের নতুন অর্গানোগ্রামে সেই নিচের স্তরটা একেবারেই স্বীকার করা হয়নি। বিমান পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, নতুন এই অর্গানোগ্রাম অনুমোদন দেয়ার আগে অনেকবারই বেশ জোরালো যুক্তি দেখানো হয়েছে, যুগ যুগ ধরে যে ২২ শ’ শ্রমিক বিমানে ক্যাজুয়াল শ্রমিক হিসেবে ( পে গ্রুপ-১) কাজ করছে তার ৮০ ভাগই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং শাখার। যেটি খুব শীঘ্রই ছেড়ে দেয়া হবে দরপত্রের থার্ড পার্টির কাছে। এখন যদি এদের স্থায়ী করা হয়- তাহলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ছেড়ে দেয়ার পর এদের কোথায় কাজে লাগানো হবে। সে জন্যই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই পে গ্রুপ -১ এর জন্য প্রয়োজনীয় সব শ্রমিক নেয়া হবে আউট সোর্সিং হিসেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান শ্রমিক লীগ ও সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান জবাব দেন-প্রথম কথা হচ্ছে গত বিশ বছর ধরে শুনে আসছি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। কিন্তুু যাচ্ছে না। আগামী এক দশকেও যাওয়ার কোন লক্ষণও নেই। কেননা বিমান টিকেই আছে এই শাখার আয়ের ওপর। তারপরও তর্কের খাতিরেও যদি নেই চলে যাবে-তাহলেও কি এই দুই সহস্রাধিক ক্যাজুয়াল শ্রমিকের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা যাবে। তখন কি শুধু তারাই বাড়ি যাবে ? ওই শাখার পরিচালক, জিএম ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্তারাদেরও তো বাড়ি যেতে হবে। ওরা গত সপ্তাহে নতুন অর্গানোগ্রাম দেখার পর কয়েক ঘণ্টা কাজে যোগ না দিয়ে শুধু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে-তাতেই সবার টনক নড়ে গেছে। ম্যানেজমেন্ট বাধ্য হয়েছে, পরবর্তী পর্ষদ সভায় আলোচনার ওয়াদা দিতে। এখন যদি এই ওয়াদার বরখেলাপ করা হয়, তখন পরিস্থিতি কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে। গত ঘেরাওয়ে তো সিবিএ ছিল না। কিন্তু পরেরটায় তো সিবিএ-কে ওরা বাধ্য করবে। আমি চাইলেও পারব না তাদেরকে থামাতে। তিনি অভিমত দেন, সরকারের অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও তো ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কোটায় স্থায়ী রাখা বিধান রয়েছে। শুধু বিমানেই যত সব মিথ্যাচার ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এটা একটা এয়ারলাইন্সের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বিমান যদি এদের স্থায়ী না করতে চায় তাহলে বিকল্প ব্যবস্থায় ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেই তাদের দিয়ে কাজ করাতে হবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, বিমানের হাজার কোটি টাকার উড়োজাহাজের চারপাশে যেই শ্রমিক কাজ করবে- তাকে হতে হবে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও স্থায়ী। তা না হলে তো একটার পর একটা উড়োজাহাজের দরজা জানালা ভাঙবেই এসব আনাড়ি শ্রমিকদের হাতে। যাদের কোন কমিটমেন্ট থাকবে না, দায়ও থাকবে না। এ বিষয়টা বিমানকেই ভাবতে হবে। এজন্যই এই ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী না করার কোন বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, বিমান শ্রমিক লীগ (সিবিএ) ২০০৯ সাল থেকে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। দাবি আদায়ে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ ছাড়াও বিমানবন্দরে ধর্মঘটও করে সংগঠনটি। গত ৪ জানুয়ারি ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আল্টিমেটাম দেয় বিমান শ্রমিক লীগ। ওইদিন বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনে সিবিএ আয়োজিত সমাবেশে সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চাকরি স্থায়ী না করলে আন্দোলনে যাওয়ার ডাক দেন। পরবর্তী সময়ে বিমান ম্যানেজমেন্টর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করে সিবিএ। এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের পর ফুঁসে ওঠে দুই সহস্রাধিক ক্যাজুয়াল শ্রমিক। তারা সেদিনই কাজ বন্ধ করে দিয়ে বলাকা ঘেরাও করায় অচল হয়ে পড়ে শাহজালাল ও শাহ আমানত বিমানবন্দর। উদ্ভূত পরিস্তিতি সামাল দিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরবর্তী পর্ষদ সভায় অর্গানোগ্রাম নিয়ে আলোচনার আশ্বাস দিলে তারা কাজে যোগ দেয়।
×