ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যেও সম্মত নয়

বাম দলগুলোর জৌলুস এখন আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৬ অক্টোবর ২০১৮

বাম দলগুলোর জৌলুস এখন আর নেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজনীতিতে বাম দলগুলোর জৌলুস এখন আর আগের মতো নেই। ভোটের হিসেবেও এসব দলের অবস্থান খুবই দুর্বল। তবুও অনেক দল এখনও একলা চলো নীতিতে বিশ্বাসী আবার অন্য একটি পক্ষ ক্ষমতাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ নিজস্ব বলয় থেকে বেরিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন বাম অনেক নেতাই। নানা অযুহাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী জোটে যেতেও নারাজ বামপন্থী অনেক দল। বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করতে সম্মত নয় দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বামপন্থী দলগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এই আহ্বানের প্রেক্ষিতে বাম দলগুলোর মতামত কী? তারাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় দেখতে চান না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আহ্বানের প্রতি কি দলগুলোর নেতাদের সমর্থন রয়েছে? বাম নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের ব্যাপারে তারা মোটেই সম্মত নন। আসন্ন আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-দুই পক্ষই তাদের জোটের আকার বাড়াতে চায়। এ জন্য আলোচনাও চলছে। সমমনা দলগুলোকে টার্গেট করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঐক্যের আহ্বানও জানানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যাদের জোটে নিতে চায় তাদের মধ্যে আছে বামপন্থীরা। গত ২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজধানীতে এক আলোচনায় বলেন, ‘আজকে একটা বিষয় ভাল লাগছে, বামপন্থীরা এক সুরে কথা বলছে। সেটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আমরা নেই। এই উচ্চারণ অনেকেই করেছে। তাহলে এই উচ্চারণ যারা করেছেন- আসুন না, আমরা মিনিমাম পয়েন্টে ম্যাক্সিমাম ইউনিটি গড়ে ফেলি। এরপর থেকেই বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসবে কিনা এ নিয়ে রাজনীতিতে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। সিপিবির নেতৃত্বে আট দলের জোটের অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করেছেন জানিয়ে কাদের আরও বলেন, ‘তাদের আদর্শের প্রতি আমার কোন অশ্রদ্ধা নেই। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এই প্রশ্নে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।’ তবে সরকারী দলের সঙ্গে বামপন্থীদের নিয়ে জোট তৈরির কোন সুযোগ নেই বলে জানান সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বলেছেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ শাসন, দুঃশাসনে রূপ নিয়েছে। এসব কারণে আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এ রকম একটা অবস্থায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির কোন জোট গঠন তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগ এটা অসম্ভব করে তুলেছে। রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও সিপিবির মধ্যে নীতি ও আদর্শগত কিছু মিল রয়েছে। আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, তেমনি সিপিবিরও ভূমিকা ছিল এই যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুটি দল ছিল ঘনিষ্ঠ। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সিপিবি সেনা শাসক জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দেয়ায় দল দুটির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তবে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি জোটবদ্ধ হয়েই নির্বাচন করে। যদিও পরে আর জোট করেনি তারা। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফের সিপিবির জোট গঠনের আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগের শাসনের কঠোর সমালোচক সিপিবি। গত ১০ বছরে দেশ ধনিক শ্রেণীর উত্থানকে ভাল চোখে দেখছে না বামপন্থী দলটি। তাদের দাবি, সরকার এই শ্রেণীতে সহযোগিতা করছে। এর ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। আবার ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদের পাশাপাশি বর্জন করেছে সিপিবিও। আর এই ভোটের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটের আলোচনাও চালিয়েছে দলটি। যদিও সেলিম সে সময় বিএনপি চেয়ারপারর্সন খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিয়েছিলেন। সিপিবি গত কয়েক বছর ধরেই বিকল্প বাম শক্তি গঠনের চেষ্টা করছে। এই লক্ষ্যে আটটি ছোট ছোট বাম দল মিলে মোর্চা গঠন করেছে। সিপিবি সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ তার নীতির পরিবর্তন করে ‘রাইট আপ সেন্টার’ থেকে এখন ‘রিএকশনের পজিশন’ নিয়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগে আপত্তি কী- জানতে চাইলে সিপিবি নেতা কওমি মাদ্রসার সনদের স্বীকৃতি দেয়ায় আপত্তির কথা জানান। বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন হেফাজতের সঙ্গে ঐক্য করছে, ইসলাম পছন্দ দল হিসেবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছে। তারা সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে বসে আছে এবং হরণ করে চলেছে। আমরা এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি বা অন্য কারও সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জোটে যাবেন না তারা। আমরা এই দুইটার (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) বাইরে বিকল্প গড়ে তুলতে চাই। বিকল্পের পক্ষে যারা আছে তাদের সঙ্গে সংগ্রামের কাফেলায় আমাদের ঐক্য, আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সিপিবির পাশাপাশি তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকীও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঐক্যের বিরোধী। বলেন, ‘সরকারী দল তাদের জবরদস্তি শাসন অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে তাদের জোট তৈরি ও ঐক্যের সম্প্রসারণ জনগণকে নতুন কিছু দেবে না। তবে রাজনীতিতে এক ধরনের সমঝোতায় আগ্রহী সাকী। বলেন, ‘বিদ্যমান অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্যে একটা সামাজিক, রাজনৈতিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে যে, আমাদের রাজনীতি কিভাবে চলবে।’ জৌলুস নেই বাম দলগুলোর ॥ ভোটের রাজনীতিতে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর আর আগের মতো জৌলুস নেই। তবুও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট ও জোট নিয়ে তাদের অবস্থান আলাদা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের ঐক্য এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কোন জোটেই নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল থাকছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। জাসদ (ইনু) পুরোপুরি বাম না হলেও তাদের অবস্থানও সরকারী দলের পক্ষে। আট দলের সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটও সরাসরি কোন দল ও জোটকে সমর্থন করছে না। তবে জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন সংগঠন গণসংহতি আন্দোলন এরই মধ্যে ড. কামাল হোসেনের ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আরও বেশ কিছু বাম দল যোগাযোগ করছে মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে গেলে পুরোপুরি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হবে এই বাম দলগুলো। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। বাম সংগঠনগুলো আগের মতো থাকতে চায় না। আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন দল এখন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। তার মানে বিএনপির প্রতি দুর্বলতা বাড়ছে দলটির। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রিধারায় বিভক্ত বাম দলগুলো রাজনীতিতে কোন তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারছে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে থাকা স্বতন্ত্র বাম দলগুলোর মধ্যে সম্প্রতি ৮ দল মিলে বাম গণতান্ত্রিক জোট করেছে। কিন্তু এই জোটের ভবিষ্যত কী? ভোটের ক্ষেত্রে বাম দলগুলো হয়ত বড় ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু এখনও কিছু মানুষ মনে করেন, ক্ষমতার পালাবদলকারী দলগুলোর বাইরে থাকা বাম দলগুলো সাধারণ জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নে কাজ করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে গিয়ে তারা দেশের সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কিনা, এটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
×