ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রান্স এশিয়ান ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় রেলপথ নতুন দুয়ার খুলে দেবে

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৫ অক্টোবর ২০১৮

ট্রান্স এশিয়ান ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় রেলপথ নতুন দুয়ার খুলে দেবে

সমুদ্র হক ॥ রেলপথকে যুগোপযোগী এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় এনে আরও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩০ বছর মেয়াদী (২০১৬-২০৪১) রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানে ৬টি পর্যায়ে ২শ’৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ’৬২ কোটি টাকা। এই প্রকল্প ট্রান্স এশিয়ান এবং আঞ্চলিক ও উপ আঞ্চলিক সহযোগিতার দুয়ার খুলে রেলকে সমৃদ্ধ করবে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে গণপরিবহনে রেলওয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে রেলকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে দেশের সকল রেলপথ হবে ব্রড গেজের। দেশে বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া উন্নয়ন মেলায় বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমান ও আগামীর উন্নয়নগুলো তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রথম বড় অর্জন যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল সংযোগ। সেতুর ওপর মালামাল পরিবহনে লোড ও গতির সীমাবদ্ধতায় অপারেশনে বিঘœতার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩শ’ মিটার উজানে স্বতন্ত্র আলাদা রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকার) ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে রেল সেতু নির্মাণের প্রকল্প ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। আশা করা হয়েছে আগামী বছর (২০১৯) এই রেল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে। রেল বিভাগ জানিয়েছে, খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন নির্মাণ, পার্বতীপুর-কাউনিয়া মিটার গেজ ট্র্যাককে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের সৈয়দ মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ, সৈয়দপুরে একটি নতুন ক্যারেজ ওয়ার্কশপ, ঈশ^রদীতে একটি আইসিডি নির্মাণে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় প্রায় ১ হাজার ৬৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই এর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে। এর পাশাপাশি ট্রান্স এশিয়ান ট্রাফিক চলাচলের জন্য হার্ডিঞ্জ সেতুর শক্তি বৃদ্ধি করা হবে। কারণ নিকট ভবিষ্যতে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথের ওপর আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সহযোগিতায় চাপ বাড়বে। গত দশ বছরে রেলের আধুনিকায়নে বহুমুখী উন্নয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। সুষ্ঠু ও নিরাপদ রেল পরিচালনায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৯৬টি স্টেশনে তা চালু হয়েছে। ৩৯টি স্টেশনে স্থাপনের কাজ চলমান। আরও ৪৭টি স্টেশনে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল রেল স্টেশন এর আওতায় আসবে। ৬৯টি গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনে অনলাইন টিকেটিং সিস্টেম (ইটিকেট) চালু করা হয়েছে। এতে যাত্রীরা সিট রিজার্ভেশন ও দ্রুততম সময়ে আন্তঃনগর টিকেট কিনতে পারছেন। দেশের ২২টি রেলওয়ে স্টেশনে ও ৬টি আন্তঃনগর ট্রেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে ওয়াইফাই সেবা চালু করা হয়েছে। রেলওয়ে সেবা, প্রশাসন, ট্রেন অপারেশন, বাণিজ্যিক কার্যক্রমসহ প্রতিটি কাজে গতি আনতে আধুনিক সফটওয়্যার ভিত্তিক কার্যক্রম প্রবর্তন করা হচ্ছে, যা রেলওয়েকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেবে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি সময় পর্যন্ত প্রায় ৩শ’৩০ কিলোমিটার নতুন রেল লাইন নির্মাণের পাশাপাশি ২শ’৪৮ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেল লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হয়েছে। রেল লাইন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ১শ’ ৩৫ কিলোমিটারেরও বেশি। রেলের লোকোমোটিভ, নতুন রেল স্টেশনসহ প্রকৌশল বিভাগে ডিজেল ইঞ্জিন, ক্যারেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রেলওয়ের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে ৮শ’৫৬ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, ১ হাজার ১শ’১০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ১শ’টি লোকোমোটিভ ৪টি রিলিফ ট্রেন, ১ হাজার ১শ’২০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৮১টি স্টেশনে সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ঢাকা মহানগরীর চারদিকে বৃত্তাকার রেল লাইন নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে পাতাল রেল, কর্নফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর কাছে দ্বিতীয় রেল কাম রোড সেতু নির্মাণ, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাবল ট্র্যাক দ্রুতগতির রেল লাইন নির্মাণ, জয়দেবপুর ঈশ^রদী সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেট ডুয়েল গেজ নির্মাণ, জয়দেবপুর-ময়মনসিং-জামালগঞ্জ সেকশনে ডুয়েলগেজ রেল লাইন নির্মাণ, নাভারন থেকে সাতক্ষীরা এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ, টুঙ্গীপাড়া থেকে ফকিরহাট ও রূপসা হয়ে মংলা পোর্ট সংযোগ রেল লাইন নির্মাণ, ভাঙ্গা জংশন থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণসহ বহুমুখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এদিকে ভারতীয় রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টের মধ্যে ৪টি চালু রয়েছে। বন্ধ ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টগুলো পুনরুজ্জীবিত করে নতুন ২টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট চালুর প্রকল্প চলমান। এ ছাড়াও বান্দরবানের ঘুমধুমে মিয়ানমার সীমান্তের সঙ্গে এবং আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তে নতুন আরও দুইটি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট প্রতিষ্ঠার প্রকল্প চলমান। প্রকল্পগুলো আঞ্চলিক ও উপ আঞ্চলিক রেলওয়ের সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। বর্তমানে দেশে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা ৩শ’ ৫২টি। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ৯০টি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস নামে আন্তঃদেশীয় ট্রেন চলছে ৪টি। নতুন রেল লাইন নির্মিত হলে এবং বিদ্যমান রেললাইনগুলোকে শক্তিশালী করে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হলে গণপরিবহনে রেলপথের গুরুত্ব অনেক বাড়বে। রেল বিভাগ বলছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনেও রেলপথ বড় ভূমিকা রাখছে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ রেলওয়ে বহুমুখী নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটাতে এগিয়ে চলেছে।
×