ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইভিএম ব্যবহার- সব স্থানীয় নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৪ অক্টোবর ২০১৮

ইভিএম ব্যবহার- সব স্থানীয় নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে

শাহীন রহমান ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত আকারে ব্যবহার হলেও আগামী স্থানীয় নির্বাচন থেকেই ইভিএম নির্ভর করতে চায় ইসি। জানা গেছে, ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যালট পেপার, কাগজ-কালি-কলম ব্যবহার করে এনালগ পদ্ধতিতে আর নির্বাচন করতে চায় না ইসি। ইভিএমের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করতে চায়। আর এর কার্যক্রম আগামী উপজেলা নির্বাচন থেকে শুরু করা হতে পারে। এরপর পৌরসভা, সিটি নির্বাচন এবং সব ইউপিতে ইভিএম ব্যবহার করতে চায়। এভাবে পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনও সম্পূর্ণ রূপে ইভিএম ব্যবহার করে পরিচালনা করতে চায়। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিগত সিটি কর্পোরেশনে ইভিএম ব্যবহারের ফলও খারাপ নয়। সেখানেও তেমন অভিযোগ ওঠেনি। ইভিএম সব সময় লাগছে। শুধু সংসদ নির্বাচন নয়, সিটি-উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন রয়েছে। প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। আস্থার জায়গাটা তৈরি হলে, এটি ব্যবহার করা হবে। ইভিএম মেশিনটা যত ব্যবহার হবে, তত উন্নত হতে থাকবে। দুর্নীতি-জালিয়াতি কমে আসবে। যেসব ত্রুটি আসবে, সেগুলো ঠিক করে আমরা আরও আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হব। ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহার করতে আরপিও সংশোধন অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। এটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। আইনে পরিণত হলে ইভিএম ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি পেয়ে যাবে নির্বাচন কমিশন। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ইভিএম ব্যবহার করতে জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচনের বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে একনেকের এক বৈঠকে ইভিএম মেশিন কেনার জন্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে জাতীয় নির্বাচন থেকে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার শুরু হবে। এরপর স্থানীয় নির্বাচনসহ সামনে সব ধরনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কমিশনের প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ইভিএমের উদ্যোগ নেয়ায় বিভিন্ন পক্ষ থেকে এর পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা চলছে। বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো প্রথম থেকেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়ে আসছেন। অপর দিকে আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো চায় দেশে ভোট ব্যবস্থার ডিজিটালাইজড করতে। এক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে জোরাল মত দিয়েছেন। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার ভাল। তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ভোটারদের ইভিএমের ব্যবহার শেখানো এবং জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করাও জরুরী। এসব করতে অনেক সময় প্রয়োজন হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছে ইভিএম ব্যবহারের দক্ষ জনমত তৈরি করতে এবং জনগণকে সচেতন করতে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য র‌্যানডম কিছু কেন্দ্র সিলেক্ট করা হবে। তবে জানা গেছে জাতীয় নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার হলেও আসছে স্থানীয় নির্বাচন থেকে আর ব্যালট পেপারের ওপরে নির্ভর করবে না ইসি। সম্পূর্ণ ইভিএমের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পরপরই সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তবে ওই নির্বাচন থেকেই আর ব্যালট পেপার ব্যবহার নাও করা হতে পারে। এরপর পর্যায়ক্রমে সারাদেশে পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে যেসব সিটি নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হবে সেগুলোতে ভোটের আয়োজনের চিন্তা ইভিএম ব্যবহার করেই হবে। জানা গেছে, সারাদেশে চার হাজারের ওপরে ইউপি নির্বাচনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে ইভিএম ব্যবহার করা হতে পারে। এদিকে নির্বাচন কমিশন থেকেও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়াতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সারাদেশে কর্মকর্তাদের আগে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা হবে। এরপর জনগণকে সচেতন করে ইভিএম মেলার আয়োজন করা হতে পারে। মেলায় কিভাবে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট দেয়া যায় তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে। সম্প্রতি নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ইভিএম ব্যবহারে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, আইনী ভিত্তি পেলে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। তবে যতটুকু পারব ততটুকুই ব্যবহার করব। ব্যবহারের আগে, ইভিএম কী, এটার উপকারিতা কী, সে বিষয়ে দেশব্যাপী প্রচার চালাতে হবে। আমাদের অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তির দিকে ধাবিত হতে হবে। ইভিএমের সুবিধা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচনের ম্যানুয়াল পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে। ম্যানুয়াল ভোটিংয়ে অনেক রকমের অসুবিধা রয়েছে। ২৫-৩০ রকমের ফরম এনভেলপ ছাপাতে হয়। ইভিএম হলে ১০-১৫ মিনেটের মধ্যে রেজাল্ট পাওয়া যায়। একজনের ভোট, আরেকজন দিতে পারে না। রাতে ব্যালট বক্স পাহারা দিতে হয় না। ইভিএম হলে কী কী উপকার হবে, কী কী হবে, কী কী হবে না। এগুলো মানুষকে জানাতে হবে। যখন ভোটার জানবে তখনই শুধু তারা এর ওপর আস্থা রাখবে। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আগামীতে সব উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইভিএমকে জনপ্রিয় করতেও নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিশ্ব ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি গ্রহণ করছে। তাই আস্তে আস্তে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে হবে। মানুষ এখন প্রযুক্তি গ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তাই পুরাতন ব্যালট পেপার আর ঘানি ব্যাগ থেকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনী সংস্কৃতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে আমাদের গবেষণা করে নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে জানান তিনি। দেশে প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়েছিল এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের সময় ২০১০ সালে। তখন বুয়েটের সহায়তায় ইভিএম তৈরি করে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার শুরু হয়। তখন বলা হয়েছিল, ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়িয়ে কাগজে ব্যালটের ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে। অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ভোটগ্রহণে সময় লাগে কম, ফলও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে। পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নিলেও ইভিএম এ বিষয়ে নিয়ে তারা আর অগ্রসর হয়নি। এ নিয়ে বুয়েটের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ফলে ২০১৩ সালের পর ইভিএম ব্যবহার থেমে যায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ইভিএম নিয়ে নতুন করে আলোচনার পেক্ষাপটে শেষ সময়ে এটি ব্যবহারের আইন সংশোধনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনে ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান ইসি সচিব। ইসি কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী মালামাল তথা স্ট্যাম্প প্যাড, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, অমোচনীয় কালি ইত্যাদি কেনাকাটা ও ব্যালট পেপার, নির্দেশিকা, ম্যানুয়াল ছাপানোর কাগজ ক্রয়সহ এনালগ পদ্ধতিতে তারা আর যেতে চায় না। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করতে এখন থেকে আস্তে আস্তে ইভিএমের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে আধুনিক পদ্ধতিতে যেতে চায়।
×