ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয়প্রার্থী বোঝাই নৌকা ফেরত

এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য প্রস্তুত ভাসানচর

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১ অক্টোবর ২০১৮

এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য প্রস্তুত ভাসানচর

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া হবে নোয়াখালীর ভাসানচরে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত¡াবধানে দ্বীপটি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে জেটি, সাইক্লোন শেল্টার, ঘরসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে স্থানান্তর কার্যক্রম। এদিকে, পরিকল্পনা থাকলেও কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়া থেকে কী পরিমাণ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। কারণ রোহিঙ্গা বিদ্রোহী নেতারা নানাভাবে নিরুৎসাহিত করছে ক্যাম্পে আশ্রিতদের। এদিকে, মিয়ানমারে নির্যাতন আগের মতো না থাকলেও সেখান থেকে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চেষ্টায় রয়েছে। অপরদিকে, নতুন করে অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে সে জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। রবিবারও বিজিবি ফেরত পাঠিয়েছে রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকা। কক্সবাজারের উখিয়ায় এখন নতুন পুরনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। বাড়তি জনসংখ্যার এই চাপ সেখানকার জনজীবনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। জনস্বাস্থ্য, বাজার দর এবং স্থানীয় শ্রমবাজারসহ সর্বক্ষেত্রে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। তাছাড়া বাঙালী অধিবাসীর চেয়ে রোহিঙ্গা বেশি হয়ে যাওয়ায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টিও হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা শুরুতে মানবিক আবেগে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে নিলেও ক্রমেই তারা বিষিয়ে উঠছে। তারা পরিণত হয়েছে নিজভূমে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। সার্বিক বিবেচনায় সরকার সেখান থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে লক্ষ্যে নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয় ভাসানচর দ্বীপকে। নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছাকাছি ভাসানচরে প্রায় ১০ হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়ণ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সেখানে রাখা হবে। নোয়াখালীর মেঘনা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ৬ হাজার একর আয়তনে জালিয়ারচর এবং ১০ হাজার একরের ঠেঙ্গারচর-এই দুটি দ্বীপের একীভূত নাম হয়েছে ভাসানচর। দ্বীপটির অবস্থান চট্টগ্রামের স›দ্বীপ উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বে। জোয়ারের সময় কিছু অংশ প্লাবিত হয়। তবে ১০ হাজার একর জমি বসবাসের সম্পূর্ণ উপযুক্ত করা হয়েছে। নৌবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আগামী ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাসানচর পরিদর্শন এবং সেখানে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ায় সেই দিনক্ষণ স্থগিত করা হয়েছে। তার সিডিউল পাওয়া সাপেক্ষে যে কোন দিন এই কার্যক্রম উদ্বোধন হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্রসহ সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গেছেন। তারা প্রথমে ভাসানচরকে বসবাস অনুপযোগী বললেও স্বচক্ষে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়। শরণার্থী সেলের একটি সূত্র জানায়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো ভাসানচর নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত ছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে রোহিঙ্গারা সেখানে থাকতে পারবে কি না। যাতায়াত কীভাবে করবে? চিকিৎসা কীভাবে হবে? কিন্তু ভাসানচর সরেজমিন পরিদর্শনের পর তাদের সেই উদ্বেগ কেটে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ভাসানচরে তৈরি করা চারতলা সাইক্লোন শেল্টারগুলো বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা যাবে। সেখানে মেডিক্যাল সেন্টার হবে, বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে। মাছ চাষের সুযোগসহ গবাদি পশু পালনের সুবিধাও থাকবে। প্রাথমিকভাবে এক লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে চরের ভূমি উন্নয়ন ও তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস। ১২০টি শেল্টার স্টেশন, মসজিদ, দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য বাসভবন থাকছে। অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় নলক‚প ও পুকুর থাকবে। এ ছাড়াও খাদ্য গুদাম, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়া, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল ফোন টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসিটিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনও নির্মাণ কাজও রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। ইতোমধ্যেই প্রকল্প যেটুকু কাজ শেষ হয়েছে তাতেই রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কাজ শুরু করা সম্ভব। সূত্র জানায়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্তাবধানে দ্বীপটিকে বাসযোগ্য করতে ৯ মাস ধরে বিরামহীন কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা হবে। তৈরি হচ্ছে ১ হাজার ৪৪০টি সেমিপাকা ঘর। প্রতিটি শেডে রয়েছে ১৮টি কক্ষ। শেডের দুই পাশে আছে বাথরুম আর কিচেন। প্রতি ৪ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারকে দেয়া হবে ১টি রুম । প্রতি রুমে থাকছে দোতলা বিশিষ্ট ২টি বেড। মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা এ চরকে ঝড়-জলোচ্ছ¡াস থেকে নিরাপদ করতে নির্মাণ করা হয়েছে ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আর চারতলা বিশিষ্ট ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার। মাটি থেকে ৪ ফিট উঁচুতে হচ্ছে বাসস্থান। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালের ২৮ নবেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের নবেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে। ভাসানচরে কেবল ১ লাখ নয়, ১০ লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। কক্সবাজারের দুটি উপজেলার জনসাধারণের জীবন জীবিকার ওপর যে চাপ পড়েছে তা থেকে স্থানীয়দের স্বস্তি দিতেই সরকারের এই প্রকল্প। ভাসানচর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় সেখানে রোহিঙ্গা বসতি নোয়াখালীতে জনজীবনে তেমন বিরূপ প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করছেন রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেছেন, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে চায় সরকার। রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে ভালভাবে বসবাস করতে পারে, সেই লক্ষ্যে বাসোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নৌবাহিনী কাজ করছে। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একত্রে এক জায়গায় বসবাস নিরাপদ নয়। তাই প্রাথমিকভাবে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের জন্য আয়ের উৎস হিসেবে ছোট দোকান, বিক্রয় কেন্দ্র, গরু-মহিষ, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, কুটির শিল্পসহ অনেক ধরনের আয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে। এদিকে, ভাসানচরে না যেতে রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিচ্ছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা। আরাকান বিদ্রোহী গ্রæপের সাবেক নেতারা চাইছে, রোহিঙ্গারা উখিয়া টেকনাফের খোলামেলা জায়গায় অবস্থান করুক। যেখানে ওসব রোহিঙ্গা নেতারা নিয়মিত যাতায়াত করছে। যোগাযোগ রাখছে ক্যাম্পে আশ্রিত কতিপয় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার সঙ্গে। বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ রয়েছে যে, উখিয়া টেকনাফে ৩০টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশী অর্থ এনে ভাগবাটোয়ারা করছে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা। ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হলে ওই জঙ্গীদের সেখানে যাওয়া আসা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাই তারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না যেতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি নুর আলম বলেন, নিজ মাতৃভ‚মি মিয়ানমার ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসার পর এখানে অনেকটা ভাল আছি। বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের সহযোগিতায় প্রত্যাবাসন শুরু হলে আমরা সহজে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারব। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নাগরিক অধিকার নিয়ে ফেরানোর জন্য সরকার আন্তরিক। তবে সার্বিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে করে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে না পারে। রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা ফেরত \ আশ্রয় শিবিরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা একদিকে তাদের বিভিন্ন দাবি পূরণ হলে স্বদেশে ফেরত যাবে বলে বললেও পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসতে মুঠোফোনে আহŸানও জানিয়ে আসছে। রয়েছে আরও রোহিঙ্গা আসার চেষ্টা। রবিবারও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় একটি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। ভোরে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে ১৭ জন রোহিঙ্গা নিয়ে একটি নৌকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। কিন্তু নৌকাটি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় তাদের আটকে দেয় বিজিবি সদস্যরা। নৌকাটিতে ৮ নারী, ৫ শিশু ও ৪ পুরুষ ছিল। তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প কমিটির চেয়ারম্যান (রোহিঙ্গা নেতা) আবদুল মতলব জানান, মিয়ানমারে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা ভাল নেই। এখনও নানা কৌশলে তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। সে কারণে রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে।
×