ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হার্ট এ্যাটাক ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

হার্ট এ্যাটাক ও করণীয়

বিভিন্ন কারণে হার্টের রক্তনালীতে চর্বি ও রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টি করে হার্টের কোষের মৃত্যু ঘটায়-চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে হার্ট এ্যাটাক বলে। যেমন ডিপ টিউবওয়েলের পানি চৌবাচ্চায় জমা হয়ে নালা/ড্রেন দিয়ে ধান খেতে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হলে ধান মারা যায়- ওকে আমরা ধান এ্যাটাক বলি। ঠিক তেমনি হার্ট এ্যাটাকও তাই। সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, রক্তে খারাপ চর্বি অতিরিক্ত মাত্রা (LDL, Total Cholesterol, Triglyceride) / ভাল চর্বির কম মাত্রা (HDL) /বংশগত কারণ (মায়ের বয়স ৫০ এর নিচে অথবা বাপের বয়স ৪৫ এর নিচে -থাকা অবস্থায় হার্ট এ্যাটাক হলে ঐ পরিবারের সন্তানদের অল্প বয়সে হার্ট এ্যাটাকের প্রবণতা বেশি থাকে)। এছাড়া অলস জীবন যাপন, মানসিক চাপ ইত্যাদির কারণে হার্ট এ্যাটাক বেশি হয়। হার্ট এ্যাটাক হলে সাধারণত বুকের মাঝখানে ব্যথা/ভারি ভারি ভাব- যা গলা, ঘাড়, পিট/হাতের বাম হাত বেয়ে ছোট আঙ্গুল, বুকের বাম দিক বা ডান দিক হয়েও ডান হাতের আঙ্গুল/ এমনকি পেটের উপরিভাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে (অনেকে এ ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মনে করেন), সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত ঘাম, বমি, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানিসহ, অস্থির ভাব হতে পারে। এমনকি রোগী সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণও করতে পারে। হার্ট এ্যাটাকের শুরু থেকে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শতকরা ২৫ জন রোগীর মৃত্যু হয় এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ২৫ জনের মৃত্যু হয়, অর্থাৎ প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ রোগীর মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই এ রোগ হলে প্রথমেই ৩০০ মিলিগ্রাম ইকোসপিরিন, ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডেগ্রেল, ২০ মিলিগ্রাম এ্যট্রোভাষ্টেটিন ২০ মিলিগ্রাম প্যান্টোপ্রাজল খেয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছে ইনজেকশন স্টেপটোকাইনেজ দিয়ে দিতে পারলে প্রায় শতকরা ২৫ জন রোগী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। পরবর্তীতে করোনারি এ্যানজিওগ্রাম করে হার্টের ব্লকের পরিমাণ ও সংখ্যা নির্ধারণ করে নিয়ে নিম্নোক্ত তিনটি চিকিৎসার মধ্যে একটি নির্ধারণ করতে হয়। ১. ছোট ছোট ব্লকের ক্ষেত্রে প্রধান রক্তনালীতে ৪০% এর নিচে বা শাখা রক্তনালীতে ৭০% এর নিচে থাকলে শুধু ওষুধ দ্বারাই চিকিৎসা নিয়ে রোগী ভাল থাকতে পারে। ২. কিন্তু ব্লকের পরিমাণ প্রধান রক্তনালীতে ৪০% ও শাখা রক্তনালীতে ৭০% বা তার অধিক হলে ব্লকগুলোকে বেলুন দিয়ে পরিষ্কার করে ঐ খানে (Stent) (যা কালভার্টের মতো দেখতে) বসিয়ে দেয়া হয় অনেকে এই পদ্ধতিকে রিং বসানো বলে থাকে। হার্ট এ্যাটাকের প্রথম ৯০ মিনিট থেকে ৩-ঘণ্টার মধ্যে এই পদ্ধতি ব্লক ছুটিয়ে রিং (Stent) বসিয়ে দিলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়-একেই প্রাইমারী পিসিআই (Primary PCI) বলে-যা বর্তমান বিশ্বে হার্ট এ্যাটাকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা, যা আমরাই এদেশের চিকিৎসকরা অহরহই করে চলেছি। ৩. যে সব ক্ষেত্রে রিং (Stent) বসানো সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে ব্লকগুলোকে পাশ কাটিয়ে নতুন রাস্তা বানিয়ে রক্ত সামনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়- এই পদ্ধতিকে বাইপাস সার্জারি বলা হয়। মোদ্দাকথা হলো, হার্ট এ্যাটাকের ফলে রক্তনালীতে সৃষ্ট ব্লকের কারণে হার্টের যে অংশ অপর্যাপ্ত রক্ত পায়- সে অংশে উপরোক্ত যে কোন একটি পদ্ধতিতে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত সরবরাহ করাই মূল কথা। একই সঙ্গে পুনরায় যেন ব্লক না হয়- সে জন্য ওষুধ খাওয়াসহ প্রতিদিন বিকেল অথবা সকালে এক ঘণ্টা হাঁটাসহ চতুষপদী জন্তু, ঘি, পামওয়েল খাওয়া বন্ধ করতে হবে। খেতে হবে ইলিশ মাছসহ সামুদ্রিক মাছ, শাক-সবজি, চামড়া ছাড়া হাঁস-মুরগি, রসুন ইত্যাদি। সর্বোপরি মানসিক চাপ পরিহার করে সহজ জীবন ধারণ করে চলতে পারলে হার্টকে সুস্থ রাখা সম্ভব। হার্ট এ্যাটাক হলে বিশ্বব্যাপী উপরোক্ত তিনটি চিকিৎসার যে কোন একটি চিকিৎসাই বিজ্ঞানসম্মত- শুধু ওষুধ ও জীবন ধারণ পরিবর্তন করে এই চিকিৎসা করার বিজ্ঞানসম্মত নয়তো বটে বরং এই তত্ত্ব অবাস্তব ও সমাজে ভুল বার্তা প্রেরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগ হার্ট এ্যাটাক নিয়ে সমাজে ভুল বার্তা প্রেরণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। আসুন আমরা এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচতে সঠিক চিকিৎসার ব্যাপারে সবাই যত্নবান হই। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ উত্তরা, ঢাকা
×