ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার বিভাগের প্রধান হয়েও অবৈধ পথে টাকা পাচার করেন সিনহা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিচার বিভাগের প্রধান হয়েও অবৈধ পথে টাকা পাচার করেন সিনহা

শংকর কুমার দে ॥ সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বাংলাদেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কানাডায় অবস্থানরত মেয়ে আশা সিনহা ও অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত সূচনা সিনহার কাছে এবং গৃহ নির্মাণ ঋণ, এক ব্যবসায়ীর কাছে থাকা নগদ অর্থসহ ৩ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাচার করে পাঠানোর তথ্য উদঘাটন করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সালে মোট ১৩ বার বাংলাদেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে উক্ত টাকা পাঠিয়েছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাবেক প্রধান বিচারপতির পিএস বাংলাদেশী নাগরিক, কানাডা প্রবাসী অভিবাসন এক আইনজীবী, সাবেক প্রধান বিচারপতির অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় অবস্থানরত দুই মেয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এ্যাকাউন্টস জব্দসহ তদন্ত করার জন্য আবেদন জানাতে পারে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যে সকল ব্যক্তি ও এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায় মানি লন্ডারিং করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী কানাডায় অবৈধ অর্থ প্রেরণের তথ্যাবলি হচ্ছে, সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাবেক প্রধান বিচারপতির একজন পিএসের কাছ থেকে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ কানাডা প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর ভাই, কানাডা প্রবাসী অভিবাসন একজন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির মেয়ে আশা সিনহার এ্যাকাউন্ট নম্বর : ৫৫১৪২৩১, ঈওইঈ (সিআইবিসি) ব্যাংক-এ পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে পাওয়া এতদসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যাদির বিবরণ, সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা কর্তৃক অবৈধভাবে উপার্জনকৃত অর্থ মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ভুয়া এ্যাকাউন্ট তৈরি করে তার কতিপয় নিজস্ব ব্যক্তির মাধ্যমে মামলার তদ্বির করিয়ে প্রচুর পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জন করেন। উক্ত অর্জিত অর্থ তিনি তার কিছু বিশ্বস্ত লোকের মারফত মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাঠান। সাবেক প্রধান বিচারপতি যে সকল ব্যক্তি ও এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায় মানি লন্ডারিং করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে, সিঙ্গাপুর প্রবাসী একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী এক ব্যবসায়ীর ভাইয়ের কাছে এবং কানাডা অভিবাসন এক আইনজীবীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির মেয়ে আশা সিনহার এ্যাকাউন্টনম্বর : ৫৫১৪২৩১, সিআইবিসি ব্যাংক-এ পাঠানো হয়। কোন তারিখে কত ডলার পাঠানো হয়েছে এবং বাংলাদেশী টাকায় তার কত মূল্যমান ধরা হয়েছে তা নির্ণয় করার পর দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে কানাডায় মোট ৮০১৭৯০০ (আশি লাখ সতেরো হাজার নয় শ’) টাকা পাঠানো হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৯ বারে ওই টাকা পাঠানো হয়। বাংলাদেশী এক ব্যবসায়ীর এ্যাকাউন্টেন্ট কর্তৃক প্রদেয় হিসাব বিবরণী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উক্ত অর্থ কানাডায় পাচারের তথ্য উদঘাটন করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রকৃতপক্ষে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ায় অবৈধভাবে যে অর্থ পাঠানো হয়েছে তার বিবরণ হচ্ছে, সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাবেক প্রধান বিচারপতির একজন পিএসের কাছ থেকে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ সুচনা সিনহা (প্রধান বিচারপতির মেয়ে), এ্যাকাউন্ট নম্বর : কমনওয়েলথ ব্যাংক, অস্ট্রেলিয়া, এ্যাকাউন্ট নম্বর : ১০৫৮৮৭৬৩ এবং শাওন বৈদ্য (প্রধান বিচারপতির মেয়ের স্বামী), এ্যাকাউন্ট নম্বর : ১০৫০৮১৩৬, কমনওয়েলথ ব্যাংক, অস্ট্রেলিয়া ও এ্যাকাউন্ট নম্বর : ৫৫১৪২৩১, ওয়েস্টপ্যাক ব্যাংক, অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হয়েছে। ২০১৬ সালে মোট ৪ বার অস্ট্রেলিয়ায় মোট ৬৮৯২০০০ (আটষট্টি লাখ বিরানব্বই হাজার) টাকা পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় তার দুই মেয়ের কাছে অর্থ পাচার করে পাঠানো ছাড়াও তিনি (সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা) হাউস বিল্ডিং লোন পরিশোধ করেন, যা ১৮/০৫/১৬ তারিখে গৃহ নির্মাণ ঋণ পরিশোধ বাবদ সিঙ্গাপুর প্রবাসী তার সাবেক এক পিএসের নিকট থেকে প্রাপ্ত টাকা হতে ৫৫৭১৯১২ (পঞ্চান্ন লাখ একাত্তর হাজার নয় শ’ বারো টাকা) টাকা গ্রহণ করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি তার সর্বমোট জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থ ছাড়াও বাংলাদেশী এক ব্যবসায়ীর নিকট আরো নগদ ১১২৪৩১৮৮ (এক কোটি বারো লাখ তেতাল্লিশ হাজার একশত আটাশি টাকা) টাকা রয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতির কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থানরত দুই মেয়ের কাছে অবৈধ উপায়ে পাঠানো অর্থ, গৃহনির্মাণ ঋণ পরিশোধে প্রদানকৃত অর্থ এবং বাংলাদেশী এক ব্যবসায়ীর কাছে থাকা অপ্রদর্শিত অর্থের সর্বমোট পরিমাণ অর্থাৎ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থের পরিমাণ (৮০১৭৯০০+ ৬৮৯২০০০+ ৫৫৭১৯১২+১১২৪৩১৮৮) ৩১৭২৫০০০ (তিন কোটি সতেরো লাখ পঁচিশ হাজার) টাকা। সাবেক প্রধান বিচারপতি উপরোক্ত পরিমাণ টাকা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি এবং আইনকানুন সঠিকভাবে জানা সত্ত্বেও রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে উপরোক্ত পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতির এই কর্মকা-ের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ এর অধীন ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় তার দুই মেয়ের কাছে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোসহ বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনাগুলোর তথ্য চিত্র পাওয়া গেছে, সাবেক প্রধান বিচারপতির আয়কর বিবরণীর সারাংশে, বাংলাদেশী এক ব্যবসায়ীর এ্যাকাউন্টস অফিসারের কাছে থাকা বিবরণীতে, কানাডায় প্রেরণকৃত অর্থের ব্যাংক কনফার্মেশন এসএমএসের স্ক্রীন শটে কানাডায় অবস্থানরত প্রধান বিচারপতির মেয়ে আশা সিনহা কর্তৃক অর্থপ্রাপ্তি স্বীকৃতির এসএমএসে অস্ট্রেলিয়ায় প্রেরণকৃত অর্থের কনফার্মেশনই- মেইলে ইন্দোনেশিয়ার পেনিন ব্যাংক হতে অস্ট্রেলিয়ায় সূচনা সিনহার এ্যাকাউন্টে প্রেরণকৃত অর্থের ডিপোজিটে পাচার করা অর্থের বিবরণ উল্লেখ আছে। যারা সাবেক প্রধান বিচারপতির টাকা মানি লন্ডারিং করেছে তাদের সকলের পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার এসব তথ্য চিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, ৩ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাচার করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) লেখা ‘এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামের বইটিতে নিজের আত্মজীবনী এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বই লিখে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। নতুন করে আলোচনায় আসার পর তদন্তে সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আর্থিক ও প্রভাব বিস্তার করার অন্তত এক ডজন অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডায় অর্থপাচার, দুদকের তদন্তে বাধা, জজ নিয়োগে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ ছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগসমূহ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন সংস্থা। এ ছাড়াও মানি লন্ডারিং, নৈতিক স্খলনসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে নিজের এবং ভাইয়ের নামে প্লট বরাদ্দে প্রভাব বিস্তার, প্লটের মূল্য পরিশোধ না করা, ১/১১ এর সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকারের আদায় করা অর্থ পুনরায় ফেরত দিতে উৎকোচ গ্রহণ, অর্থপাচার, দুদকের তদন্তে বাধা, জজ নিয়োগে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন যেসব অভিযোগ রয়েছে তার তদন্তপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করছে গোয়েন্দা সংস্থা।
×