ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক

১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং খাতে আদায় অনিশ্চিত খেলাপী বা মন্দ মানের ঋণ বেড়েই চলেছে। গত ছয় মাসে এ ধরনের ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বেড়েছে খেলাপীর বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ। চলতি বছরের জুন শেষে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারী-বেসরকারী ১৩টি ব্যাংক। এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক। জুন শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। মূলত খেলাপী ঋণ বাড়ার কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদায় অনিশ্চিত খেলাপী বা মন্দ মানের ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৬৪ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের মন্দ মানের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। বেসরকারী ৪০ ব্যাংকের এই ঋণের পরিমাণ ৩১ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। বিদেশী ৯ ব্যাংকের ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। আর সরকারী বিশেষায়িত ২ ব্যাংকের ৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। মাত্রাতিরিক্ত এই মন্দ মানের ঋণের প্রভাবে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ১৩টি ব্যাংক। চলতি বছরের জুন শেষে সরকারী-বেসরকারী ১২ বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৯টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছিল। এরপর চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে ১২টিতে উন্নীত হয়। সর্বশেষ জুনে আরও বেড়ে ১৩টি ব্যাংকে উন্নীত হয়েছে। খেলাপী ঋণ বাড়ার কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এতে ঐ ব্যাংকের শেয়ারে নিরুৎসাহিত হন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কাও থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সরকারী লোকের দাপটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বেশকিছু ঋণ দেয়া হয়েছিল। যা পুনঃতফসিল করে খেলাপী ঋণ ঢেকে রাখা হয়েছিল। এ ধরনের মন্দ ঋণ এখন খেলাপী হয়ে বেরিয়ে আসছে। একইভাবে বেসরকারী ব্যাংকগুলোয়ও কিছু দুষ্ট লোক রয়েছে। তাদের দাপটে যেসব ঋণ দেয়া হয়েছিল, তা এখন খেলাপীতে পরিণত হয়েছে। ফলে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা চলছে। যেভাবে খেলাপী ঋণ বাড়ছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলার নেই। খেলাপী ঋণ বাড়লে প্রভিশন ঘাটতি বাড়বে। আবার ঋণ অবলোপনের পরিমাণও বাড়ছে। ফলে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েই চলেছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলো প্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোন প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নি¤œমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, জুন শেষে ১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। মার্চে ১২ ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। ৩ মাসের ব্যবধানে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা। মার্চের ১২টি ব্যাংক ছাড়াও নতুন করে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রায় ১৬০ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে যুক্ত হয়েছে। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, খেলাপী ঋণ বেশি থাকলে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ে। এ ছাড়া ব্যাংকের লেজার বুক পরিষ্কার করতে হলেও প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংক। তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রভিশন ঘাটতিতে আলোচিত বেসিক ব্যাংকের অবস্থান প্রথম সারিতে। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত আরও দুটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি যথাক্রমে ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ও ৮৯০ কোটি টাকা। এবি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৪৭ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৪২২ কোটি, একটি ইসলামী ব্যাংক ১৬০ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের প্রায় ২১ কোটি এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১০৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ৪৭৮ কোটি টাকা, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের ৩২৮ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঘাটতি ১১৬ কোটি টাকা এবং স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি কিছুটা কমে ৪৬ কোটি টাকা।
×