ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

টিম ম্যানেজমেন্টের নির্লজ্জ ক্লাবপ্রীতিতে নতুন সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে চলেছে, স্ট্রাইকারদের গোল করতে না পারার ব্যর্থতাও দেখছেন অনেকে, অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতার পরও কোচ জেমি ডে দেশের ফুটবলের উন্নতি দেখছেন, সমালোচনা না করে বরং শিষ্যদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই ই

বাংলাদেশের ব্যর্থতার নেপথ্যে...

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  বাংলাদেশের ব্যর্থতার নেপথ্যে...

জাহিদুল আলম জয় ॥ হতাশায় ভেঙ্গে পড়া দেশের ফুটবল আবারও কোমর সোজা করছিল। একের পর এক ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছিল ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর। ওইদিন থিম্পুতে এশিয়ান কাপের প্রাক-বাছাইয়ে ভুটানের কাছে ১-৩ গোলে হেরে বাংলাদেশের ফুটবলের সলিল সমাধি হয়েছিল। শাস্তিস্বরূপ আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকেই নির্বাসিত হয়েছিল লাল-সবুজের দেশ। ইতিহাসে কোনদিন যাদের কাছে হারের নজির ছিল না, সেই ভুটানের কাছে হার দেশের ফুটবলের অন্যতম বড় লজ্জা। দুই বছর আগের ওই ক্ষত শুকিয়ে ধীরে ধীরে কক্ষপথে ফিরছিল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। যে প্রমাণ মেলে এশিয়ান গেমসে। এই আসরে বাংলাদেশের যুবারা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১০০ ধাপ এগিয়ে থাকা ২০২২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক কাতারকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো নকআউট রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এশিয়াডে যুবারা যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়ররা যোগ দিয়ে সেটা দপ করে নিভিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে যখন পুরো জাতি বিভোর তখনই ধপাস করে পড়ে যেতে হলো মাটিতে। শনিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নেপালের কাছে ০-২ গোলে হেরে সব হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই হারে টানা চারটি সাফের গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাহাড়ী দেশ ভুটানের কাছে হারের ধাক্কা শুকোতে না শুকোতে হিমালয়ের দেশের ধাক্কায় আবারও আগের জায়গায় ফিরে এসেছে দেশের ফুটবল। এ যেন সেই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের ওপরে ওঠার প্রচেষ্টা! বাংলাদেশের সীমাহীন এই ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের নির্লজ্জ ক্লাবপ্রীতির কারণেই নতুন সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হচ্ছে বলে দাবি করেছেন অনেকে। মাঠে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের দাবি, জাতীয় দলটাকে একটা ক্লাব বানিয়ে ফেলা হয়েছে। তাদের অভিযোগের তীর সত্যজিৎ দাস রূপুর দিকে। তিনি একাধারে জাতীয় দল ও আবাহনীর ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ আছে, ম্যানেজার নিজের ক্লাবের ফুটবলারদের আধিক্য দিয়ে থাকেন জাতীয় দলে। এখানে যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতিটাকেই বড় করে দেখা হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ শহিদুল আলমকে গোলরক্ষক হিসেবে খেলানো। নেপালের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রথম গোল হজম করেছেন শহিদুল তা ক্ষমার অযোগ্য। যে কেউ ওই বল রিসিভ করতে পারে। আবাহনীর খেলোয়াড় হওয়ার কারণেই তাকে খেলানো হয়েছে বলে অভিযোগ। কোচ জেমি ডে’কে ভুলভাল বুঝিয়ে এই কাজটি করেছেন সত্যজিৎ দাস। হাস্যকর গোল হজম করা শহিদুলকে নিয়ে সমালোচনা হলেও তারচেয়ে দায় বেশি টিম ম্যানেজমেন্টের। স্কোয়াডে থাকা সব ফুটবলারই সেরা একাদশে খেলতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেরা ১১ জনকে বেছে নেয়ার দায়িত্ব টিম ম্যানেজমেন্টের। প্রশ্নটা এখানেই? এখন শহিদুলের মু-ুপাত করে তো লাভ নেই। নিশ্চয়ই তিনি জোর করে মাঠে নামেননি। যারা টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিবেচনা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে ফুটবলাঙ্গনে। এশিয়ান গেমসে তাক লাগানো সাফল্য পাওয়া গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানাকে বাইরে রেখে শহিদুলকে নেয়া হয় একাদশে। অথচ এই শহিদুল ক্যাম্পেই ছিলেন না। তাকে বলির পাঠা না বানিয়ে তাই টিম ম্যানেজমেন্টের কাছেই জবাবদিহিতা চাওয়া উচিত বাফুফের। গোলরক্ষকের এমন ভুল নতুন নয়। জুন-জুলাইয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপেও বেশ কয়েকজন তারকা গোলরক্ষক হাস্যকর গোল হজম করেছেন। শহিদুলকে নিয়ে পড়ে না থেকে তাই এই ব্যর্থতার আসল কারণ উদঘাটন করা উচিত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের। ফুটবলবোদ্ধা ও সমর্থকদের মতে, এই ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রাইকারদের গোল করতে না পারা। ম্যাচে দল দুই একটা গোল হজম করতেই পারে, এটা খেলারই অংশ। কিন্তু স্ট্রাইকারদের কাজ কী? তাদেরও তো গোল করা উচিত। কিন্তু এই সাফে তিন গ্রুপ ম্যাচে বাংলাদেশের স্ট্রাইকারদের অর্জন কী? নিশ্চিতকেরই শূন্য। তিন গ্রুপ ম্যাচে বাংলাদেশের স্ট্রাইকাররা গোল পেয়েছেন মাত্র একটি। ভুটানের বিরুদ্ধে গোলটি করেন মাহবুবুর রহমান সুফিল। ওই ম্যাচে আরেকটি গোল করেন যিনি তিনি ডিফেন্ডার তপু বর্মণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনরকম জয়ে গোল করেন আবারও সেই তপু। তৃতীয় ম্যাচে তো নেপালের গোলের আশেপাশেই যেতে পারেননি সাদ, জামাল, মামুনরা। পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডরা শতভাগ ব্যর্থ। প্রতিটি ম্যাচেই যদি ডিফেন্ডারদের যেয়ে গোল করতে হয় সেই দলের এমন পরিণতি হওয়াটাই স্বাভবিক। স্ট্রাইকারদের গোল করতে না পারার সক্ষমতার অভাবের কথা টুর্নামেন্টের আগেই বলেছিলেন কোচ জেমি ডে। ঘরোয়া ফুটবল ঢেলে না সাজালে এই অবস্থার উত্তরণ কখনই সম্ভব নয়। প্রিমিয়ার লীগে প্রায় সব দলেই খেলে থাকেন চার/পাঁচজন করে বিদেশী ফুটবলার। এদের বেশিরভাগই ফরোয়ার্ড। ফলে দেখা যায় বাংলাদেশের স্ট্রাইকাররা খেলারই সুযোগ পান না। তাহলে গোল পাবেন কী করে? বর্তমানে সাফের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি দু’জনই বাংলাদেশের। এরপরও স্বাগতিকের সুবিধাটুকু নিতে পারেননি তারা। অভিযোগ আছে, ভারতকে খুশি করতে তাদের গ্রুপে মাত্র তিনটি দল রাখা হয়েছে। যে কারণে ওই গ্রুপে এক জয় পেয়েই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের গ্রুপে রাখা হয়েছে চারটি দল। যার খেসারত দিতে হয়েছে টানা দুই ম্যাচ জিতেও গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে। বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন স্বয়ং বাংলাদেশ কোচ জেমি ডে। তিনি বলেন, ‘সেমিতে উঠতে না পেরে আমি হতাশ। ম্যাচে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। ছেলেরা ভাল করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা দুই ম্যাচ জিতেও সেমিফাইনালে যেতে পারিনি। অন্যদিকে একটি (‘বি’ গ্রুপ) দল এক ম্যাচ খেলে সেমিতে চলে গেছে। ৫ দিনে আমাদের তিনটা ম্যাচ খেলতে হয়েছে। এটা খুব কঠিন।’ এরপরও বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নতি দেখছেন কোচ। নেপাল লজ্জার পর সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়লেও বিচলিত হননি এই ইংলিশ। চোখেমুখে না পাওয়ার বেদনা থাকলেও জামাল, তপু, সুফিলদের নিয়ে আশাবাদী। গোলরক্ষক শহিদুলেরও পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সী এই কোচ মনে করেন, এক হারেই সব শেষ হয়ে যায়নি। বরং বাংলাদেশের ফুটবল সঠিক পথেই আছে বলে দাবি করেন জেমি, ‘শেষ ১৬ ম্যাচে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। আমাদের উন্নতি করার আরও জায়গা আছে। আমরা এখন জিততে শিখেছি। এই ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েই আমাদের সবাইকে বেশি ভাবতে হবে। আমি আমার খেলোয়াড়দের নিয়ে গর্বিত।’ সাফল্য পেলে দর্শক মাঠে আসে সে প্রমাণ হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জনস্রোত হয়েছে। কিন্তু সাফের সেমিতে উঠতে না পারার ব্যর্থতার কারণে আগামী মাসে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে দর্শক কতটা মাঠে আসবে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। এশিয়ান গেমসে শেষ ষোলোতে উঠে বাংলাদেশ এশিয়ার সেরা ১৬ দলের একটি হয়েছিল। কিন্তু সাফের ব্যর্থতার কারণে ওই সাফল্য এখন আড়ালে চলে গেছে। এই অবস্থা থেকে দেশের ফুটবল কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
×