ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আবারও অচলাবস্থা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আবারও অচলাবস্থা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আবারও অচলাবস্থা শুরু হয়েছে। লেবার হ্যান্ডেলিং ঠিকাদার, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আমদানি-রফতানিকারকদের দ্বন্দ্বের কারণে ১ সেপ্টেম্বর থেকে সকল প্রকার পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে সরকার প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। পাশপাশি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লোড আনলোড শ্রমিকসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এদিকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে পাঁচদিন ধরে চলা অচলাবস্থার কারণে বন্দরের উভয় পাশে আটকা পরেছে কয়েকশ’ যানবাহন। কিন্তু তারা পণ্য খালাসের অনুমতি পত্র (কারপাস) না পাওয়ায় দেশেও ফেরত যেতে পারছেন না। এ ঘটনায় বুধবার দুপুরে ভারত ও ভুটান থেকে আসা ট্রাক চালকরা বন্দর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। উত্তরের শেষ জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে চতুর্দেশীয় বাণিজ্যের একমাত্র বন্দর। কিন্তু অবস্থানগত কারণে সম্ভাবনাময়ী এই স্থলবন্দরটি এখন পুরোপুরি একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। ‘বাংলাবান্ধা ল্যান্ডপোর্ট লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য বন্দরের ইজারা দেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে এই বন্দর দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে চতুর্দেশীয় বাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে আমদানিকৃত পণ্য ওঠা-নামানোর কাজ করতেন স্থানীয় কুলি শ্রমিকদের দুইটি সংগঠনের সদস্যরা। কিন্তু সম্প্রতি পাথরসহ তিন দেশের আমদানিকৃত পণ্য উঠানামার জন্য লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুলের মালিকানাধীন ‘এটিআই লিমিটেড’ নামক একটি কোম্পানিকে লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের ইজারা দেয়া হয়। এরপর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের টাকা, সরকারী রাজস্ব এবং বন্দর চার্জ নিয়ে বন্দরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এটিআই লিমিটেড এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের দফায় দফায় বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে প্রায় চার মাস ধরে স্থলবন্দরে দেখা দেয় অচলাবস্থা। দুদিন চালু থাকলে তিন দিন বন্ধ থাকে বন্দরটির আমদানি রফতানি কার্যক্রম। বিভিন্ন ইস্যুতে কুলি শ্রমিকসহ ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় বিক্ষোভও করেন। এ নিয়ে বন্দর এলাকায় যেকোন সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এদিকে বন্দর চালুর পর থেকে ব্যবসায়ীরা বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য আনলোডিংয়ের জন্য শ্রমিকদের টন প্রতি ৩১ টাকা করে প্রদান করতেন। কিন্তু বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ব্যবস্থাপকের স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, ‘আমদানি-রফতানিকৃত সকল পণ্য বাংলাবান্ধার অভ্যন্তরে প্রবেশের পর কাস্টমস ছাড়পত্র ইস্যুর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ট্যারিফ সিডিউল অনুযায়ী লোড আনলোড চার্জসহ যাবতীয় বন্দর চার্জ পরিশোধের পর পণ্যের গেট বা আউট পাশ ইস্যু করা হবে।’ চিঠির তথ্যমতে বন্দরের লোড আনলোডের জন্য ‘এটিআই লিমিটেড’ নামে ওই প্রতিষ্ঠানকে লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের ইজারাদার নিয়োগ করা হয়। ইজারাদারের পরিচয়ধারী শ্রমিক ছাড়া কেউ লোড আনলোড পরিচালনা করতে পারবে না বলেও চিঠিতে বলা হয়। এছাড়া ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের অধীনে লোড আনলোডের জন্য পণ্যের টন প্রতি ফি বাবদ ১০৪ টাকা এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই ১০৪ টাকার মধ্যে পণ্য লোড এবং আনলোডের কথা থাকলেও এটিআই লিমিটেট এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বন্দর ইয়ার্ডে পণ্য আনলোড করে দেয়। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, আমদানিকৃত পণ্য বন্দর ইয়ার্ডে এবং ইয়ার্ডের বাইরে নিজেদের খরচে লোড করে বাইরে পাঠাতে হয়। এজন্য ভ্যাটসহ ১১৯.৬০ টাকার সমুদয় টাকা পরিশোধ করেননি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। আর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা টাকা পরিশোধ না করায় ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় দুই কোটি ৪৫ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এ জন্য এটিআই লিমিটেড এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ কুলি শ্রমিকদের টাকাও পরিশোধ করেনি। আর এ কারণে স্থানীয় কুলি শ্রমিকরাও পণ্য লোড আনলোড বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে আমদানিকারকরা পূর্বের নিয়মে টনপ্রতি শুধুমাত্র ৩১ টাকা পরিশোধ করেই পণ্য আমদানি করতে চান। লোড আনলোড বিল, সরকারি রাজস্বসহ বন্দর চার্জ বাবদ ভ্যাটসহ আমদানিকৃত পণ্যের টনপ্রতি ১১৯ টাকা পরিশোধ না করায় বন্দর কর্তৃপক্ষও পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়। এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ, এটিআই লিমিটেট, কুলি শ্রমিক ও আমদানিকারকদের দ্বন্দ্বের কারণে অচলাবস্থা শুরু হয় এই স্থলবন্দরে। তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান কুদরদ-ই-খুদা মিলন বলেন, ‘এই স্থলবন্দর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা দরকার। নানা সঙ্কট নিয়ে প্রায়ই বন্দরে অচলাবস্থা দেখা দেয়।’ আমদানিকারক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘কোন রকম টেন্ডার ছাড়াই গোপনে এটিআই লিমিটেট নামে একটি শ্রতিষ্ঠানকে শ্রমিক নিয়োগ ও লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের ইজারা দেয়ার পর থেকেই স্থলবন্দরে এই অচলাবস্থা শুরু হয়। আমরা লোড আনলোডের টাকা পরিশোধ করলেও আমাদের গাড়ি লোড করে দিচ্ছে না। এতে আমাদের প্রতি টনে বাড়তি ৬০ টাকা দিয়ে লোড করিয়ে নিতে হচ্ছে। আমদানিকারক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ লোড না করে দেয়ায় আমাদের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পণ্য লোড করিয়ে নিতে হয়। এতে আমাদের খরচ বেশি পড়ছে। কিন্তু আমরা বেশি দরে পাথর বিক্রি করতেও পারছি না। তাই লাভ তো দূরের কথা লোকসান হচ্ছে। লোকসান করে তো আর আমরা ব্যবসা করতে পারব না। সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক নাসিমুল হাসান নাসিম বলেন, ‘আমরা নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত চার্জ পরিশোধ করেই পণ্য আমদানি করতে চাই। এ জন্য ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন বন্দরে আসছেন। কিন্তু এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ একমত না হওয়ার কারণে সকল প্রকার আমদানি রফতানি বন্ধ রয়েছে।’
×