ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গানে গানে কবিগুরুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে...

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে...

মোরসালিন মিজান ॥ রবীন্দ্রনাথের গানে কী আছে? না, এ প্রশ্নের চট জলদি উত্তর হয় না। কী যেন আছে। কিংবা বলা যায়- সবই আছে, যা চাই। বাণীর গভীরতা সুরের মাধুর্য বাঙালীকে কবে কোনকালে অধিকার করে নিয়েছিল, আজও টানটি থেকে কেউ মুক্ত হতে চান না। পারেননি। বরং নিজেকে আরও বেশি জড়িছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এমন মোহাবিষ্ট শিল্পী এবং শ্রোতাদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। বিশাল মিলনায়তনে দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা। মূলত বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ দিসবে অনুষ্ঠানটি আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে এক মাস পিছিয়ে ভাদ্র মাসে আয়োজন করা হয়। আয়োজনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যÑ এখানে অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পীরা গান করেন। খ্যাতিমান শিল্পীদের গান শোনারও সুযোগ হয়। প্রতিবারের মতো এবারও সবাই মিলে গানে গানে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ভালবাসা নিবেদন করেছেন। দ্বিতীয় দিনে শনিবার অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে কী যে ভাল বোধ হলো! এত বড় মিলনায়তনের পুরোটাই রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য বরাদ্দ, ভাল না লেগে পারে? মঞ্চের দিকে তাকাতেই দৃশ্যমান হন সৌম্য শান্ত চেহারার রবীন্দ্রনাথ। প্রতিকৃতির পাশে তাঁরই উদ্ধৃতি, যেখানে বড় করে লেখা রয়েছে, ‘অহংকার চূর্ণ করো/প্রেমে পূর্ণ করো।’ এটি এবারের আয়োজনের থিম। রবীন্দ্রনাথ যত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, ততটাই ছিলেন নিরহঙ্কারী। ভালবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করতে চেয়েছিলেন তিনি। আজকের পৃথিবীতে এই যে যুদ্ধ, যুদ্ধাবস্থা, একে অপরের সঙ্গে বিবাদ, তার বিপরীতে আমরা খুব কিছু তো পাইনি। বরং ভালবাসা দিয়ে মানুষের পৃথিবী গড়া অনেক সহজ। এ কথাটি প্রচার করতেই আয়োজকরা এমন থিম নির্বাচন করেছেন। অনুষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পীদের প্রাধান্য। একের পর এক গান গাইছিলেন শিল্পীরা। শুনেই বোঝা যায়, নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ভাল, আরও ভাল করার চেষ্টা লক্ষণীয়। খ্যাতিমান শিল্পীরাও গাইলেন। এভাবে সবাই মিলে প্রণতি জানালেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। ভালবাসা জানালেন। এদিনও সংস্থার নির্ধারিত শিল্পীদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান থেকে নির্বাচিত পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও বিচিত্র পর্যায়ের গান পরিবেশন করেন বরেণ্য শিল্পীরা। সমাপনী দিনের প্রথম শিল্পী ছিলেন ফাহমিদা হোসেন। দীর্ঘকাল ধরে গাইছেন। এদিন তার কণ্ঠে ছিলÑ অগ্নিবীণা বাজাও তুমি/কেমন করে।/আকাশ কাঁপে তারার আলোর/গানের ঘোরে।/তেমনি করে আপন হাতে/ছুঁলে আমার বেদনাতে,/ নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি/জীবন-’পরে...। মুগ্ধ হয়েই শোনা হলো তার গান। সংস্থার অন্যতম শিল্পী ও সংগঠক পীযূষ বড়–য়া গাইলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ধারার গান। তার গাওয়া ‘আজি/ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/পরাণসখা বন্ধু হে আমার’ সাধারণ শ্রোতাও বেশ উপভোগ করেন। অপেক্ষাকৃত নবীনদের মধ্যে শিল্পী কনক খান গাইলেন, ‘আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে/তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে...।’ এভাবে নানা আঙ্গিকের গানে সাজানো ছিল অনুষ্ঠান। সংগঠনের সভাপতি শিল্পী তপন মাহমুদ, উপদেষ্টা আমিনা আহমেদ, সালমা আকবর, মহাদেব ঘোষ প্রমুখও শ্রদ্ধা জানান কবিগুরুকে। শিল্পী তালিকায় আরও ছিলেনÑ গোলাম হায়দার, বিষ্ণু ম-ল, শাফিকুর রহমান খান, খোকন চন্দ্র দাস, খন্দকার আবুল কালাম, মাখন হাওলাদার, আহমেদ জিয়াউর রহমান, সুবাহ্ আকবর, টিপু চৌধুরী, তপন কুমার সরকার, নির্ঝর চৌধুরী, খন্দকার খাইরুজ্জামান কাইয়ুম, ফেরদৌসী কাকলী, কাকলী গোস্বামী, মিতা দে, রমা বাড়ৈ, রুমঝুম বিজয়া রিসিল, সীমা সরকার প্রমুখ। অন্ধজনে দেহো আলো, অরূপ তোমার বাণী, তোমায় গান শোনাব, চোখের আলোয় দেখেছিলেম ইত্যাদি গানে দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান। আয়োজনের দ্বিতীয় দিনেও প্রাধান্য ছিল নবীনদেরই। কয়েকজন নবীন গানে গানে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পী অনিন্দিরা রায়ের সঙ্গে। অবশ্য নবীন বলা হলেও, তিনি গাইছেন অনেকদিন ধরে। বললেন, এ মঞ্চটি আমার জন্য বিশেষ। এখানে যারা শ্রোতার আসনে বসেন, তারাও রবীন্দ্রপ্রেমে ডুবে থাকা মানুষ। সংবেদনশীল বোদ্ধা শ্রোতা। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমাদের একটা মেলবন্ধনের সুযোগ হয়। তার চেয়ে বড় কথা, তাদের কাছ থেকে ভাল জাজমেন্ট পাই। এ প্রসঙ্গে একদিন আগে নিজের গাওয়ারা কথা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, আমার গান শুনে শ্রদ্ধেয় তপন মাহমুদ স্যার ডেকে বলেছেন, খুব ভাল হয়েছে। এই যে পাওয়া, এ তো যে কোন মঞ্চে গেয়ে পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান একটি সাধনা। তিনি আমার প্রেম। সেই প্রেমের কথা এখানে এসে জানাতে পারি। আরেক নবীনের নাম মতিউর রহমন। তিনি বলেন, শিল্পী সংস্থার মঞ্চে কবিগুরুর গান গাইতে পারা বড় সুযোগ। আমি এ মঞ্চ থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে সত্যি আনন্দিত। নবীনদের সুযোগ দেয়া হলে তারা ভবিষ্যতের মঞ্চকে আলোকিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। অনুষ্ঠানে কথা হয় সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সাজেদ আকবরের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের অনুষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত নবীনরাই বেশি গাইছেন। তারা তাদের পছন্দের গান করার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন কবিগুরুর প্রতি। অনেকে শংসয় নিয়ে বলেন, এত বড় মঞ্চে নতুন শিল্পীদের গান শ্রোতা শুনবে তো? আমরা তবুও তাদের গান করার সুযোগ করে দিচ্ছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার উৎসবে দেড়শর মতো শিল্পী গান করেন। তার পরও সমালোচনা, কেউ তেমন ওঠে আসছে না তো। আমরা বলি, গাইতে না দিলে ওরা ওঠে আসবে কী করে! এদের মধ্য থেকেই ওঠে আসবে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওঠে আসতে পারবে বলেই আশা আমাদের।
×