ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা!

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা!

শাহীন রহমান ॥ রাজধানী ঢাকা কি আসলেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে? বিগত ৭ বছরের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা রিপোর্ট, ঢাকার নদীর দূষণ নিয়ে উচ্চ আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞ মতামত এদিকটাই ইঙ্গিত করছে। ঢাকার বায়ু দূষণ, পরিবেশ জনসংখ্যা স্বাস্থ্য অবকাঠামো এবং বসবাসের অযোগ্যতার তালিকায় গত ৭ বছরের আন্তর্জাতিক জরিপে চারবারই ঢাকার নাম এসেছে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে। সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় ঢাকা নগরীর অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকার নদী দূষণ নিয়ে ২০০৯ সালে আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, দূষণসহ সার্বিক বিপর্যয় রোধ করা না গেলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ কতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গৃহনির্মাণ ব্যবস্থাপনাসহ সর্বক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। খেলার মাঠ, পার্ক, জলাধারসহ পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় ঢাকা মহানগরী শুধু বসবাসের একটি অযোগ্য নগরই নয় এটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যেসব বিবেচনায় এই তালিকায় বারবারই ঢাকার নাম উঠে আসছে। তার মধ্যে পরিবেশ দূষণ বেশি আলোচিত। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ থেকে শুরু করে নদী দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০০৯ সালে আদালতের এই রায়ের পরে গত সাত বছরের আন্তর্জাতিক সব জরিপে ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় সবার ওপরে স্থান দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ এ বছরের লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্ট ইউনিট যে জরিপ পরিচালনা করেছে সেখানেও ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে অবস্থান দেয়া হয়েছে। তারা বলছে অবকাঠামো স্থিতিশীলতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি সংস্কৃতি ও পরিবেশ দূষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ছোট্ট এই নগরী আজ লোকসংখ্যার ভারে নূয়ে পড়ার উপক্রম। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঢাকার লোকসংখ্যা। সরকারী হিসেবেই ঢাকায় বর্তমানে লোকসংখ্যা রয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ। তাদের হিসেবেই ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার লোক বসবাসের কথা বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংখ্যা ২ লাখের বেশি। তারা বলছেন ঢাকা লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে ৬৩ শতাংশ। শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যার ৪০ ভাগ হচ্ছে ঢাকায়। দেশের জিডিপির ৩৫ শতাংশ ঢাকা থেকে আসে এবং দেশের সামগ্রিক কর্ম সামর্থ্যরে ৩০ ভাগ ঢাকায় বসবাস করে। ঢাকার বস্তিগুলোর জনঘনত্ব বাংলাদেশের একটি সাধারণ গ্রামের তুলনায় ৩০ ভাগ বেশি। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া লোকজনের শেষ ঠিকানা এই ঢাকা। তারা বলেন, ঢাকা গত ৭ বছর যাবত বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ নম্বরে উঠানামা করছে। তারা বলছেন যতবার এইসব জরিপ চালানো হচ্ছে সেখানে ঢাকার একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মূলত ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বারবার একই ফলাফল উঠে আসছে। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং পরিবেশ সংগঠন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, বাংলাদেশ কতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের একটি বড় অংশ আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে, জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। জল ও জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গৃহ নির্মাণ ব্যবস্থাপনাসহ সর্বক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। খেলার মাঠ, পার্ক, জলাধারসহ পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় আমরা মনে করি ঢাকা মহানগরী শুধু বসবাসের একটি অযোগ্য নগরই নয় এটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সব ধরনের সেবার সুযোগ সম্ভাবনা সব কিছুতেই একটা চাপের মুখে পড়েছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। অবকাঠামোগত স্থিতিশীলতার কারণেই এটি ঘটছে। আবার সামান্য পথ যেতে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটে প্রতিদিন ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া বায়ুর মানমাত্রা জরিপেও ঢাকা নিচের দিকে অবস্থান করছে। ঢাকার বায়ুর মান ক্রমেই নিচে নামছে। বায়ু দূষণের যে গবেষণা রিপোর্ট গত ২০১৬ সালে প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে ঢাকার বায়ু মান দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় বারবারই ঢাকা শহরকে বায়ু দূষণের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন যৌথ উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের বায়ুর মানমাত্রা অত্যন্ত নিম্ন মানের, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সহনীয় মাত্রার চেয়ে ঢাকা এবং আশপাশের গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ শহরে বিপজ্জনক মাত্রায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। এই দূষণের কারণে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর বস্তুকণা এ সব এলাকার বাতাসে বিরাজ করছে। অধিদফতরের বায়ুর মানমাত্রা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ যেখানে ১শ’ পিপিএম পার হলেই বিপজ্জনক মাত্রা বলে ধরে নেয়া হয় সেখানে নারায়ণগঞ্জে এর পরিমাণ ৮২১ পিপিএম, গাজীপুরের ৪৪০ পিপিএম এবং ঢাকায় ৪১৬ পিপিএম। পরিবেশ অধিদফরের জরিপ অনুযায়ী বায়ু দূষণের শতকরা ৫৮ ভাগ সৃষ্টি হচ্ছে এর আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাঁটির কারণে। এসব ইটভাঁটির বেশিরভাগই পরিবেশবান্ধব নয়। অনেক ইটভাঁটি পরিচালিত হচ্ছে অবৈধভাবে।
×