ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রমত্তা পদ্মার করাল গ্রাস

নড়িয়ার ৫ শতাধিক বাড়িঘর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিলীন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নড়িয়ার ৫ শতাধিক বাড়িঘর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিলীন

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর, ৬ সেপ্টেম্বর ॥ পদ্মার অব্যাহত ভাঙ্গনে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ২শ’ বছরের পুরনো মূলফতগঞ্জ বাজারসহ আশপাশে ৫ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কাঁচা-পাকা বসতঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে পুরনো এ বাজারের আরও সহ¯্রাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সরকারী-বেসরকারী অফিস, ব্যাংক, বীমা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বসতঘর। যে কোন মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে নড়িয়া উপজেলার একমাত্র ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও বাজারসংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী মূলফতগঞ্জ মাদ্রাসা। এদিকে ভাঙ্গন রোধে সরকার ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে পদ্মার পাড়ে যে জিও ব্যাগ ফেলানো হয়েছিল তা কোন কাজেই আসেনি। ঠেকানো যায়নি ভাঙ্গন। প্রতিদিনই বিলাসবহুল বাড়িঘরসহ শ’ শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাওয়ায় পদ্মার পাড়ে চলছে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লোকের শোকের মাতম। সরকারী হিসেব অনুযায়ী এ বছর নড়িয়া উপজেলার পদ্মার পাড়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার পরিবারের বাড়িঘর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনকবলিতরা একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে দিশেহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটছে। পদ্মার তীরবর্তী এলাকার লোকজনের চোখে ঘুম নেই। তারা দিন-রাত তাদের সর্বশেষ সম্বল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট সরিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও চোখের সামনেই মুহূর্তে বিলীন হচ্ছে সবকিছু। এলাকাবাসীর দাবি, ভাঙ্গন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এখনও নড়িয়া বাজার, ঐতিহ্যবাহী মূলফতগঞ্জ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। ভাঙ্গনকবলিত এলাকাবাসী সুজন ঢালী, ইব্রাহীম ঢালী জানান, এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই রাক্ষুসী পদ্মা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দক্ষিণে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। গত ৫ দিন ধরে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ৩শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মূলফতগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশ। ইতোমধ্যে এই বাজারে অবস্থিত নূর হোসেন দেওয়ান ও ইমাম হোসেন দেওয়ানদের তিন তলা ৪টি ভবনসহ ৩ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একেকটি ভবন ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময় শ’ শ’ লোকজন শুধু আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব ভবনগুলো চোখের সামনেই বিলীন হলেও কারও পক্ষেই করার কিছু ছিল না। ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত জয়নাল দেওয়ান, জবেদ দেওয়ান, নাছির দেওয়ান জানায়, এলাকার সর্বস্বহারা মানুষগুলো দিন রাত একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজলেও তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা পায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। তারা বর্ষার আগেই চেয়েছিল সরকারী কোন সাহায্য নয় পদ্মার দক্ষিণ তীরে নড়িয়া উপজেলা শহর এবং পুরনো এ মূলফতগঞ্জ বাজারটি রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ ভয়াবহ ভাঙ্গন রোধে সরকার পদ্মা নদীর দক্ষিণ (ডান) তীর রক্ষাবাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করে। এরপর গত ২ জানুয়ারি তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে তা একনেকের বৈঠকে পাস করে। বর্ষার আগে এ সব এলাকার হাজার হাজার মানুষ স্থায়ী বেড়িবাঁধের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু আইনী জটিলতার কারণে বাঁধ নির্মাণ কাজ এখনও শুরু করা হয়নি। বর্ষার শুরু থেকে অব্যাহত ভাঙ্গন শুরু হলে ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে কিছু জিও ব্যাগ ফেলে নদীর গতি পরিবর্তনের চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং কাজ ধীর গতিতে হওয়ায় ভাঙ্গন রোধে কোন কাজেই আসেনি সরকারে এ অতিরিক্ত বরাদ্দ। রক্ষা করা যায়নি ঐতিহ্যবাহী এ বাজারসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, বিলাসবহুল বহুতল ভবনসহ হাজার হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি। এ এলাকার অনেক বিত্তবান লোকজন সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত নেই। ইতোমধ্যে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মালামাল সরিয়ে অন্যত্র নেয়া হয়েছে এবং হাসপাতালের রোগীদের পাশের একটি ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতি ভাঙ্গন আতঙ্কে এসব এলাকা থেকে বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে নেয়ায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে বাজার, হাসপাতালসহ আশপাশের এলাকার বিদ্যুত সংযোগ। কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ঈমাম হোসেন দেওয়ান, হাসেম দেওয়ান বলেন, গত ২ মাসে পদ্মার ভাঙ্গনে প্রায় ৪ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। কোন জনপ্রতিনিধিসহ সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তারা কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা করেনি। এলাকায় মহাদুর্যোগ চলছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের ছেলে মেয়েদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। আমরা এখন ভূমিহীনদের কাতারে চলে এসেছি। এতে আমাদের দুঃখ নেই। এখনও যদি সরকার দ্রুত গতিতে পদ্মার দক্ষিণ তীর রক্ষাবাঁধ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে তাহলে আরও হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘরবাড়ি রক্ষা করা সম্ভব হবে। নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, পদ্মা নদী নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অতি কাছে চলে আসায় হাসপাতালের মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রোগীদের জন্য হাসপাতাল ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বের আবাসিক দুটি ভবনে ভর্তি কার্যক্রম এবং জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোপূর্বে প্রায় আড়াই হাজার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ৩শ’ ৫০ জন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ২ বান্ডিল করে টিন ও নগদ ৬ হাজার করে টাকা বিতরণ করা হবে।
×