ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মারা এখনও সক্রিয়

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মারা এখনও সক্রিয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মারা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের ইতিহাস বিকৃত করেছিল, দেশকে উল্টো পথে নিয়ে গিয়েছিল সেসব প্রেতাত্মারা এখনও সক্রিয়। তাদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আমি কখনও আপোস করিনি, করবও না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ বেয়েই আমরা দেশকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শুক্রবার বিকেলে গণভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। আর ছাত্রলীগের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই শোকাবহ আগস্টের আওয়ামী লীগ গৃহীত মাসব্যাপী কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘটে। ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও উস্কানি দিয়ে একটি মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে একটি মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় নেমে পড়ে। ছোট্ট ছোট্ট ছাত্রদের ঘাড়ে পা রেখে অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছিল। এদের অনেকে নাকি আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। আমার প্রশ্ন- অনেক জ্ঞানী-গুণী ও খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা ওই সময় কী করেছেন? আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। সেই প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনে উস্কানি দেয়া হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই উস্কানি ও গুজবের ফলে কত শিশুর প্রাণ যেতে পারত, কত শিশুর ক্ষতি হতে পারত কেউ কী তা ভেবে দেখেছে? তিনি বলেন, আমরা যখন গুজব সৃষ্টিকারী ও উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলাম তখন দেখলাম অনেকের হাহাকার! আন্তর্জাতিক কত চাপ। কিন্তু আমি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করি। দেশের স্বার্থে কোন ছাড় নেই। আমার বাবা-মা’র কাছ থেকে শিখেছি নীতির প্রশ্নে কোন আপোস নেই, করবও না। দেশে-বিদেশের সবাইকে তা মনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমার রাজনৈতিক জীবনে গ্রেনেড হামলা, গুলি, বোমা হামলাসহ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আমাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমি কোন কিছুর পরোয়া করিনি। কারণ আমার আত্মবিশ্বাস আছে যে, আমি সত্য ও ন্যায়ের পথে। দেশের মানুষের কল্যাণ ও তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমরা রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য থেকে কেউ আমাকে বিচ্যুত করতে পারবে না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে নিজেদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলে ন্যায়-প্রগতি ও শান্তির পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই আমরা বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছি, স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের কাতারে। আমরা আর বেশি দিন থাকব না। তোমরাই (ছাত্র) দেশের ভবিষ্যত। তোমাদেরই আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। নিজেদের একেকজন আদর্শিক নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আদর্শ নিয়ে নিজেকে গড়ে তুললে ইতিহাসে তোমরাই মূল্যায়ন পাবে, স্থান পাবে। কিন্তু ধন-সম্পদের দিকে গা ভাসালে হারিয়ে যাবে। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই আদর্শচ্যুত হয়ে হারিয়ে গেছে, অনেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিসহ নানা দলে চলে গেছে। শিক্ষাই একমাত্র সম্পদ এ কথাটি সবসময় মনে রাখার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দেশের প্রতিটি অর্জনের পেছনে ছাত্রলীগের বিরাট অবদান রয়েছে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া, জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে শহীদের তালিকা দেখলে দেখা যাবে, এক্ষেত্রে শহীদের তালিকায় ছাত্রলীগেরই বেশি সদস্য রয়েছে। তাই ছাত্রলীগকে আদর্শিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ধন-সম্পদ চিরদিন থাকে না, কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু শিক্ষাই একমাত্র সম্পদ যা কেউ কোনদিন কেড়ে নিতে পারে না। তাই ছাত্রলীগের প্রতিটি সদস্যকে সর্বাগ্রে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ নিজের ভাগ্য বদলের জন্য রাজনীতি করে, কেউ সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো ও নিজেদের ধন-সম্পদ বাড়ানোর জন্য রাজনীতি করে। তারা দেশকে কিছু দিতে পারে না। কিন্তু যারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে, ইতিহাস তাদের মূল্যায়ন করেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতি করার চেষ্টা হলেও তাঁর আদর্শ মুছে ফেলা যায়নি। সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। সত্য উদ্ভাসিত হবেই একদিন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বাজানো নিষিদ্ধ ছিল, সেই ভাষণটিই আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে, প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার নিয়ে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু নিজেকে কখনও পরিবর্তন করিনি। তাঁতের শাড়ি ফেলে শিফন শাড়ি, ভারি মেক্যাপ কিংবা চুল ফুলিয়ে তুলিনি। বরং পদে থেকে প্রতিটি সময় জনগণের জন্য কতটুকু করতে পারলাম, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ও মুখে হাসি ফোটাতে কতটুকু করতে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে সব চেয়ে বড় কথা। এটাই আমার রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি বলেই মাত্র সাড়ে ৯ বছরে বাংলাদেশ আজ স্যাটেলাইট যুগে পৌঁছে গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব। এই সাড়ে ৯ বছরেই বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। ত্যাগের লক্ষ্য নিয়ে কাজ না করলে দেশ এতটা এগিয়ে যেতে পারত না। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। মাতৃভাষার অধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন-এ দীর্ঘ আন্দোলনে জাতির জনকের পাশাপাশি তাঁর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে নিজের জীবন বিপন্ন করে দৃঢ়চেতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার মা ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর স্ত্রী হয়ে কখনও ভোগ-বিলাসে গা ভাসাননি, বরং দেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। নিজের সন্তানরা যেন ভোগ-বিলাসে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য কখনও বঙ্গভবনে থাকেননি, মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মতো সন্তানদের গড়ে তুলতে ৩২ নম্বর ধানম-ির বাসভবনেই সাধারণভাবে থেকেছেন, আমাদের সেভাবেই মানুষ করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে যা কিছু শিখেছি মা-বাবার কাছ থেকেই শিখেছি। স্বাধীনতার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের নেপথ্যের কারিগরও ছিলেন বঙ্গমাতা উল্লেখ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ঐতিহাসিক ৬ দফা নিয়েও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। বাবা বন্দী অবস্থায় থাকার সময় আমার মা দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছেন, সেটিই হবে। কোন আট দফা হবে না। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তিরও বিরোধিতা করে আমার মা বলেছিলেন- কোন প্যারোলে নয়, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে পরিপূর্ণ মুক্তি দিলেই বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। ওই সময় আন্দোলন-সংগ্রামেরও নেপথ্যের কারিগর ছিলেন আমার মা। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেও আমাদের অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুকে এসে বলেছেন একথা সেকথা বলতে হবে। তখন আমার মা বঙ্গবন্ধুকে ডেকে বলেছিলেন- দেশের মানুষের জন্য সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছ। দেশের মানুষের কিতে ভাল হয় তোমার থেকে কেউ আর ভাল জানে না। তাই তোমার মনে যা আসবে ভাষণে সেই কথাটিই বলবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে কোন নোট নিয়ে যাননি। নিজের মনের কথাই বলেছেন। আর সেই ভাষণটিই আজ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৫ আগস্ট নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি, স্বামীর (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গেই নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন বঙ্গমাত্রা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নানা ষড়যন্ত্র ও ইতিহাস বিকৃতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ১৫ আগস্টের মাত্র ১৫ দিন আগে শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর চাকরিস্থল জার্মানিতে গিয়েছিলেন। এর কয়েকদিন পরেই একরাতে আমরা সব হারিয়ে এতিম হয়ে গেলাম। কিন্তু আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করা হয়নি। উল্টো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়া ইনডেমনটি দিয়ে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয় এবং খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাকে দেশে ফিরতে দেয়নি জিয়া। রিফিউজি হিসেবে আমাদের দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, এ হত্যাকা-ের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাসকে হারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু খুনীদের দোসরদের কোন ষড়যন্ত্রই বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ সত্যকে কখনও মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁর অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, রাজনীতি করি দেশের মানুষের জন্য, তাদের কল্যাণ ও ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য। নিজে কী পেলাম বা কী পেলাম না, সেই হিসেবের অঙ্ক কষার আমার কোন সময় নেই। দেশের মানুষকে কতটুকু দিতে পারলাম সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা। যারা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে, কল্যাণে কাজ করে একদিন ইতিহাসই তাদের মূল্যায়ন করে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই আমরা বাংলাদেশকে তাঁর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই।
×