ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ আগস্টের ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা করে খালেদা সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩১ আগস্ট ২০১৮

একুশ আগস্টের ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা করে খালেদা সরকার

শংকুর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য নির্দেশ দেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার নির্দেশ দেন তার প্রমাণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সেই সময় জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণ। তার এই ভাষণটির পরই বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে পাশ্বর্¦বর্তী দেশ ভারতের ওপর গ্রেনেড হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ধামাচাপা দিতে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার নানা কৌশল নিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল আলামত নষ্ট করা, ভুয়া জবানবন্দী দেয়া, বিচারিক তদন্তের নামে কাল্পনিক কাহিনী তৈরি, আওয়ামী লীগের ওপরই দোষ চাপানো। কিন্তু পরে সব কিছুই ভুয়া প্রমাণ হয়, যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও ওই সরকারের সর্বোচ্চ মহলসহ সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন না। ভয়াবহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন বহুল আলোচিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) নির্দেশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিকে দায়িত্ব দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হত্যাচেষ্টার পর অষ্টম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনের তৃতীয় কার্যদিবসে ১৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে একথা বলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশন ১০ দিনের মাথায় সরকারের কাছে ১৬২ পাতার প্রতিবেদন দেয়। যেখানে ২১ আগস্টের ঘটনার পেছনে বিদেশী শক্তির হাত আছে বলা হয়। কিন্তু কোন্টি সেই দেশ তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বলা হয়, প্রতিবেশী একটি দেশে এই হামলার মহড়া হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এই গ্রেনেড হামলা চালায় এবং পাশ্বর্¦বর্তী দেশের (ভারতের) গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় এই গ্রেনেড হামলা চালানো হয় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সে সময় তার এই প্রতিবেদন রীতিমতো হাসির খোরাক হয়। পরে সেটি অবশ্য আর প্রকাশ করা হয়নি। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে গঠিত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের এক সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি প্রমাণ করে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা কিভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। শুধু তাই নয়, সে সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার তদন্ত ধামাপাচা দিতে যত চেষ্টা হয়েছে, তার মধ্যে বহুল প্রচলিত হলো জজ মিয়া নাটক। আর তদন্তের এক পর্যায়ে সব উদ্ঘাটনের দাবি করে কথিত জজ মিয়ার জবানবন্দী নিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফেঁদেছিলেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুর রশিদ ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের ভার পাওয়ার পর তিনিও হেঁটেছেন সাজানো পথে। আর সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, এক হকার জজ মিয়াই এই ঘটনার মূল হোতা। ঘটনার ১০ মাস পার হলে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়া ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দেন। তাতে তিনি বলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড মারতে এসেছেন। কারা এই বড় ভাই? জবাবে তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালে জজ মিয়া নাটকের সব ভ-ুল করে দেন তার মা জোবেদা খাতুন। একটি পত্রিকাকে তিনি বলেন, জজ মিয়া গ্রেফতারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে খোরপোষের টাকা দিয়ে আসত। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও বলেন জোবেদা। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাটি বিএনপি-জামায়াতের সাজানো নাটকের ঘটনা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন, জজ মিয়া নাটকেই শেষ নয়। আলামতও নষ্ট করে তারা। গ্রেনেড হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করে। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এই মামলার তদন্তে জোট সরকার যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। তারা দেশেও আসে। কিন্তু তখন সরকার ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত গ্রেনেড নষ্ট করে দেয়। আরও নানা আলামত নষ্ট করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরেও অনুরূপ গ্রেনেড পাওয়া গেলেও সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে আমন্ত্রণ জানিয়েও কোন রকম সহযোগিতা করা হয়নি। সহায়তা করা হয়নি বাংলাদেশে তদন্তের জন্য আসা মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই ও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলকেও। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কর্মকা-ে বিরক্তি প্রকাশ করে তদন্ত সংস্থাগুলো বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্ট করে তার প্রকাশ পায় ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোন তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করতে বলেছিলেন। সে তদন্ত প্রতিবেদন আর কোন দিন প্রকাশ করা হয়নি। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে এই মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব পান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির। ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন সিআইডি কর্মকর্তা ফজলুল কবির। এই অভিযোগপত্রে চারদলীয় জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু তার ভাই তাইজউদ্দিন আহমেদ, হরকত-উল-জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। সেই সঙ্গে জজ মিয়াসহ ২০ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করা হয়। ওই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান জবানবন্দী দেন। যেখানে তিনি বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং সেই সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সে সময়ের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ তৎকালীন সিআইডি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম ফাঁস করে দেন। পুনঃতদন্তের ভিত্তিতে সিআইডি ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্র মিলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের পতœী আইভি রহমান। সৌভাগ্যক্রমে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আহতদের অনেকেই গুরুতর আঘাত নিয়ে দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছেন।
×