ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে মহাজোটের আকার আরও বড় করার পরিকল্পনা

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের টার্গেট আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৯ আগস্ট ২০১৮

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের টার্গেট আওয়ামী লীগের

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকারী দল আওয়ামী লীগের টার্গেট এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তারই অংশ হিসেবে আসন্ন নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। ক্ষমতাসীন জোট ও জোটের বাইরে ৩৬টি নিবন্ধিত দল নিয়ে কাজ করছে সরকার। ছোট ছোট অনিবন্ধিত দলের সঙ্গেও বিভিন্ন মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা। তবে এক্ষেত্রে বিএনপির বিষয়ে কোন ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীনরা। এমনকি নির্বাচনে বিএনপির সংলাপ বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবির বিষয়েও সরকারের তরফে কোন ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হবে না। আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দু’ধরনের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এক ধরনের পরিকল্পনা, অংশ না নিলে ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগোবে তারা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে মহাজোট নিয়ে অগ্রসর হবে ক্ষমতাসীনরা। সেক্ষেত্রে মহাজোটের আকার আরও বড় করবে তারা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায় আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনতে নেয়া হবে নানা ধরনের পদক্ষেপ। বোঝাপড়ার মাধ্যমে এসব দলকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আগামী মাস থেকেই মাঠে নামবেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আনতেই হবে বা বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে বিষয়টি এরকম নয়। গত নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে বিএনপি আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বিষয়টি তুলে ধরে অনুকম্পা লাভের চেষ্টা করেছিল। এবার আওয়ামী লীগ ওই ফাঁদে পা দেবে না। এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য কাজ করছে সরকার। বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও নিবন্ধিত অন্য অনেক দল আছে যারা নির্বাচনে এলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেতে বিএনপির অংশগ্রহণ কোন ফ্যাক্টর নয়। অধিকসংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটাই বড় কথা। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপি না এলেও তারা ছাড়া বাকি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নেবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা আশাবাদী বিএনপি নির্বাচনে আসবে। কারণ কোন ষড়যন্ত্র যে সফল হবে না এটা সবাই ভাল করেই জানে। আর আগামী নির্বাচনে অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের কোন অভাব হবে না। আমরা চাই সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু কোন দল নির্বাচনে না এলে তো আমাদের কিছু করার নেই। নির্বাচনে বিএনপি না এলে সময় ও ¯্রােত তো অপেক্ষা করবে না। সংবিধান থেকে আমরা একচুলও নড়ব না। জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, আগামী নির্বাচনে কে এলো আর কে এলো না- সেটা বড় কথা নয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যারা আপোসের কথা বলে তারা আসলে রাজাকার ও খালেদা জিয়াকে হালাল করার কথা বলেন। কিন্তু রাজাকার, জঙ্গী লালনকারীদের সঙ্গে কোন আপোস হবে না। তাদের আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে চিরতরে মাইনাস করতে হবে। তবেই আমরা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব। সম্প্রতি যুবলীগের এক আলোচনা সভায় একই ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও অংশগ্রহণকারী দলের কমতি হবে না। বিএনপি অংশ নিলে বড় দল হিসাবে নির্বাচন পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে। কিন্তু বিএনপি না এলেও নির্বাচন থেমে থাকবে না। অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যার ঘাটতি হবে না। এবার কেউ সেই ফাঁদে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার) পড়ছে না। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার মতে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা যে কোন রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকারের কাজ নয় কোন দলকে নির্বাচনে আনার। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তারা বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাস, শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পরও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো বড় মন্ত্রণালয় দেয়ারও আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন বলেই বিএনপি নেত্রীর পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর শুনে সমবেদনা জানানোর জন্য খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি নেত্রী দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ঢুকতে দিলেন না। তখন থেকেই মূলত সংলাপের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের মতে, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খলেদা জিয়াকে টেলিফোন করে কোন সাড়া পাননি। উল্টো প্রধানমন্ত্রীকে অপমানিত হতে হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপে ডাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বিএনপি ছাড়াও অনেক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। ওই দলগুলো নির্বাচনে এলেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোটা পূরণ হবে। বিএনপি আবারও ভুল করলে তাদের সঙ্গে থাকা অনেক শরিক দল এমনকি বিএনপিরও অনেক নেতা নানা জোটে অংশ নিয়ে নির্বাচনে আসতে পারেন। আর তা হলে ওই নির্বাচন বিদেশী বন্ধুদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এ কারণে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপ বা আলোচনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। সূত্রগুলো জানায়, আদালতে সাজা হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয় আওয়ামী লীগ। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানও আদালত কর্তৃক ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। রক্তাক্ত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ও সন্নিকটে। ওই মামলায় হামলার মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমানের যে নিশ্চিত সাজা হবে এমনটাই আশা করছেন মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারী কৌঁসুলিরা। তাই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রেখে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে কি না, সেটি দেখতে আরও দু’মাস অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে দুটি কৌশল নিয়েই এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে এলে ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ছাড়াও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্বাচনকালীন মহাঐক্যজোট গড়ে তুলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। সেক্ষেত্রে আগে বিএনপিতে ছিল, এখন বাইরে গিয়ে পৃথক রাজনৈতিক দল করেছে, এমন দলগুলোকেও কাছে টানার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে দলগুলোকে বিভিন্ন ছাড় দেয়াসহ যা যা করার তার সবই করবে তারা। আর বিএনপি অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র ১৪ দলকে নিয়ে নির্বাচনে যাবে। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি আলাদা নির্বাচন করতে পারে। জাতীয় পার্টির বাইরে বিএনপিমনা অন্যান্য দল ও জোটকেও নির্বাচনে এনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে আওয়ামী লীগ। কাউকে বিএনপির অভাব বুঝতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী একাদশ নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে একটি বৃহৎ জোট গঠনের পথেই হাঁটছেন তারা। অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে বিএনপি নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়েই নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। মহাজোট ছাড়াও নির্বাচনী মোর্চায় আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে কাছে টানবে তারা। দুই জোটের বাইরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জোটকেও নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট, তৃণমূল বিএনপি এবং ইসলামভিত্তিক সাতটি দলের একটি জোটও আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। সব মিলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে যত বেশি সম্ভব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতিই থাকছে ক্ষমতাসীনদের। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। ৩১ দলীয় এই জোটকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও গ্রিনসিগন্যাল দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দলটির একাধিক নেতা জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করে বলেন, তাদের জোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে থাকছে। তবে নির্বাচনের গতিবিধির ওপর নির্ভর করবে কোন রূপরেখায় তারা জোটে থাকবেন। সেটা পরবর্তীকালে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা বাম প্রগতিশীল ধারার বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গেও নির্বাচন নিয়ে নিজেদের কাছে টানতে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বাম ঘরানার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরাসরি এবং টেলিফোনে আলোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গেও তাদের আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনী জোটে না আসলেও দলগুলো যেন আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেটিই ছিল আলোচনার মূল কথা। এর বাইরেও নিবন্ধিত বিভিন্ন দলের সঙ্গেও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। মূল কথা, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অর্থবহ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে সব ধরনের পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ।
×