ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ দেশের শিক্ষক ও পেশাজীবীর গবেষণায় তথ্য প্রকাশ

৬ বছরে হত্যা করা হয়েছে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০১৮

৬ বছরে হত্যা করা হয়েছে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্যে বছরের পর বছর রোহিঙ্গাবিরোধী নানামুখী অভিযানে কত সংখ্যক প্রাণ হারিয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনও প্রকাশ হয়নি। তবে গত ছয় বছরে ৩০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নর নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করতে সে দেশের নীতি নির্ধারক মহল নীলনক্সা প্রণয়ন করেছে বহু আগে। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে নানা ছলছুতায় সে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সবক’টি উইং এবং এর সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বড় একটি অংশ কেবলই হিংস্র ছোবল হেনেছে রোহিঙ্গাদের ওপর। ৫টি দেশের শিক্ষক ও পেশাজীবীদের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য। যা প্রকাশ হয়েছে গত ২২ আগস্ট। প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজ কর্তৃপক্ষ। গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ ছয় বছরে প্রায় ৩০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার ধরন ছিল গুলি, জবাই, পিটিয়ে এবং শিশুদের আগুনে নিক্ষেপের মাধ্যমে। আগুনে নিক্ষেপ করে শিশু হত্যা করা হয়েছে ৫ সহস্রাধিক। নিক্ষেপ করা হয়েছিল আরও বহু। এরা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে। আগুনে পোড়া ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এদের হবে আগামীর পথ চলা। অবশিষ্টদের বিভিন্ন বর্বর কায়দায় মারা হয়েছে। তবে বেঁচে থাকা এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মতে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মোট সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ লাখ। এদের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই বসবাস ছিল প্রায় ১৫ লাখের। দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে কিছু। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে আরও। এদের মধ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে রয়েছে এককভাবে ১২ লক্ষাধিক। তন্মধ্যে গত বছর ২৫ আগস্ট রাতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে ৭ লক্ষাধিক। যা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। মূলত রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। ২০১৭ সালে ঘটল নজিরবিহীন পর্যায়ে। রোহিঙ্গাদের হত্যা সংক্রান্তে গবেষণা রিপোর্টটি প্রস্তুতের আগে এর সঙ্গে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কানাডা, ফিলিপাইন ও নরওয়ের একদল শিক্ষক ও পেশাজীবী। রিপোর্ট তৈরির জন্য এ দলটি উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত ৩ হাজার ৩শ’ রোহিঙ্গার সাক্ষাত গ্রহণ করেছে। গত জানুয়ারি মাসে গৃহীত রোহিঙ্গাদের ইন্টারভিউ এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর মিয়ানমারের বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও এটি স্থান করে নেয়। তবে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, গত বছরের ২৬ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে ১২ সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে হত্যা ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ওপর নানাভাবে বর্বরতা চালানো হয়েছে। হত্যার পাশাপাশি নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও চলেছে রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে। রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত ফসলের ক্ষতিসাধন, লুটপাট, গৃহপালিত পশু থেকে শুরু করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। গত বছরের ২৬ আগস্ট রাখাইনে যে সেনা অভিযান শুরু হয় তার আগে রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরসার সশস্ত্র ক্যাডারদের দ্বারা সে দেশের পুলিশ ও সেনা চৌকিতে হামলার কথা জানান দেয়া হয়। যা আদৌ সত্য কিনা এ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। এরপরই সেনা সদস্যদের অভিযানের পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মীয় সন্ত্রাসীরাও একযোগে হামলে পড়ে রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে। এর আগে ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে এক যুবতী হত্যাকা-কে ঘিরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে বেশকিছু রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মংডুতে তিনটি পুলিশ পোস্টে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার কথা জানান দিয়ে নির্যাতনের মাত্রা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। আরসা সন্ত্রাসীদের আটকের অভিযানের কথা জানান দিয়ে সেনা সদস্যরা নজিরবিহীন নির্যাতন বর্বরতা, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। ওই সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়। কিন্তু বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ও কোস্টগার্ডের কড়াকড়ি থাকায় তখন ঢালাওভাবে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু ফাঁক-ফোকরে অনেকেই চলে আসে। এরপরও ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুদফায় সীমান্ত গলিয়ে সরকারী হিসাব অনুযায়ী আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। যদিও বেসরকারী হিসাবে এ সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখ। তখন থেকে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা এলাকায় বস্তি তৈরি করে এদের আশ্রয় হয়। এরপর মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে ২ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হয়। থেকে যায় আরও ৩২ হাজার, যারা শরণার্থীর মর্যাদা নিয়ে এখনও বাংলাদেশে রয়েছে। এদের পরিবারে নতুন করে জন্ম নেয়াদের সংখ্যা এর কোন সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। তবে আগে থেকে আসা এবং গত বছর যে ঢল এসেছে সব মিলে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে বাংলাদেশে। গেল বছরের ঘটনার পর সরকার মানবিক কারণে এদের জন্য সীমান্ত সিল না করে প্রবেশের সুযোগ দেয়। ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। এ সংখ্যা বিভিন্ন সংস্থার মতে ভিন্ন ভিন্ন। তবে জাতিসংঘের মতে ৭ লাখেরও বেশি। এদিকে, গত সোমবার রাখাইন রাজ্যের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তা মিয়ানমারের জন্য নতুন একটি বড় ধরনের ধাক্কা বলে বিবেচিত হচ্ছে। মিয়ানমারে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নেতাদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে সেনাবাহিনী ও সুচি সরকারকে দোষারোপ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সে দেশের সেনা প্রধান ও ৫ সিনিয়র জেনারেলসহ ২০ বর্মী নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আবার এও বলা হচ্ছে, সেনা সমর্থিত সরকারের মূল নায়ক আউং সান সুচি জাতিসংঘের এ রিপোর্টের পর নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের এ রিপোর্ট প্রকাশের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তারা শীঘ্রই এ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বৈঠক আহ্বান করতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পক্ষে প্রকাশিত রিপোর্টের পর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নতুন করে নানা জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ রয়েছে অনেকের। কিন্তু নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া না যাওয়ার পক্ষের সংখ্যাই বেশি। তবে সে দেশের এনভিসি কার্ড নিয়েও অনেকে বসবাস করতে আগ্রহী। তবে শঙ্কা রয়েছে কখন আবার রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার পক্ষ হামলে পড়ে। এ নিয়ে শঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
×