ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ জাতির পিতার স্থান একান্তই তাঁর

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৬ আগস্ট ২০১৮

বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ জাতির পিতার স্থান একান্তই তাঁর

ওয়াজেদ হীরা ॥ পূর্ব আকাশে সূর্য তখনও উঁকি দেয়নি। অথচ কাকডাকা ভোরেই অসংখ্য মানুষের পদচারণায় ঢল নামল ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে। বুধবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শোকার্ত মানুষের এই ঢল নামে। শোকার্ত মানুষের মিছিলে কে নেই! যতদূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। শিশু থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ সবাই এককাতারে কালোব্যাজ ধারণ করে ফুল নিয়ে এসে হাজির বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে। শোকার্ত মানুষের মিছিল যেন বলে দিচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু এখনও কোটি বাঙালীর প্রাণের মধ্যেই আছে। শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বাঙালীর হৃদয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু। আর তরুণ প্রজন্ম মনে করছেন বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। আর তাঁর প্রতি দলমত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধাও থাকতে হবে একই সঙ্গে, রাখতে হবে সব বিতর্কের উর্ধেও। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোর থেকেই আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনের রাস্তায় জমায়েত হতে থাকে। জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের ঢল নামে। ছোট্ট শিশু আসফিয়া আনিকা (৮) বাবার হাত ধরে এসেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। বাবার মতো মেয়ের বুকেও লাগানো রয়েছে কালো ব্যাজ। স্বাধীন দেশ, স্বাধীনতা কিংবা দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান কোন কিছুই বোঝে না তবুও ছোট্ট শিশুটি বলেন, ‘আমি তো পড়েছি বইয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা। বাবা অনেক ছবি দেখিয়েছে। আমি বাবার মুখে শুনেছি উনি ভাল মানুষ। আনিকার বাবা আশরাফুল ইমরান বলেন, বাচ্চাদের তো পরিবার থেকেই সঠিক শিক্ষাটা দিতে হবে। এখানে নিয়ে আসাটা তারই একটি কারণ। ছোট থেকেই শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে গড়ে উঠুক আমার আগামী প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা বর্তমান প্রজন্মের জন্য ইতিহাস। কিন্তু এই প্রজন্মের তরুণরা মনে করেন ‘জাতির পিতার আসনটা একান্তই বঙ্গবন্ধুর। ধানম-ি ৩২সহ বিভিন্ন স্থানে তরুণদের সঙ্গে কথা বলে নানা অভিব্যক্তি জানিয়েছে প্রজন্মের তরুণ শিক্ষার্থীরা। ধানম-িতে ফুল হাতে অপেক্ষমাণ বদরুননেসা কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না বলেন, দেখুন, আপনি কোন্ দল করেন সেটা বিষয় নয়। আপনাকে স্বীকার করতে হবে এই রাষ্ট্র তৈরির কারিগর বঙ্গবন্ধু। তাঁর প্রতি যেন সবাই শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায় সে প্রত্যাশাও করে এই শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বলেন, দেখুন, জাতির জনক নিয়ে কারো কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। এই বাঙালীর জন্যই তো বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন। আমাদের একটি দেশ উপহার দিয়েছেন। তবুও বলব, আজ (বুধবার) শোকের একটি দিন। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এদিন। বাঙালী হিসেবে এটি লজ্জারও বটে। আমি বাঙালী হিসেবে এই লজ্জার দায় এড়াতে পারি না। কেননা, আমরা আমাদের জনককেই হত্যা করেছি। এই শিক্ষার্থী বলেন, দেখুন, হত্যার মাধ্যমেও তাঁকে কিন্তু শেষ করা যায়নি। আমার বিশ^াস সবার মনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আলাদা একটা জায়গা, ভালবাসা আছে। এই দিনে আমি তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরেক ঢাবি শিক্ষার্থী বিপ্লব বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালে এবং বর্তমানে এত উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয় দেশটির জন্ম কিন্তু বঙ্গবন্ধুই দিয়ে গেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম বলেই আজ তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে পারলাম। বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে আইনে পড়া শিক্ষাথী তাবাসসুম মাবিয়া বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছে আমাদের কাছে শুধু শোনা গল্প মাত্র। আমাদের নানা-নানি-দাদা, দাদিদের কাছে শুনেছি সেই সময়ের বঙ্গবন্ধুর জীবন কথা। ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র একজন লোক কী করে কোটি কোটি বাঙালীকে মোহিত করেছিলেন। গল্প শুনেই উপলব্ধি করি একজন শেখ মুজিব কীভাবে সারাদেশের তরুণ-যুবাদের নাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন। নাড়া দিয়েছিলেন পুরো বাংলা ও বাঙালী জাতিকে। তাঁকে নিয়ে আগামীতে আরো গবেষণা হওয়া উচিত। তাঁর ভাষণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব সব কিছুই গবেষণার মাধ্যমে জানানো উচিত। যাতে তরুণরা সে আদর্শ মানতে পারে। এদিকে ধানম-িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তেমনই এক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কেমন মানুষ ছিল এই প্রজন্মকে শুধু তাঁর জীবনী পড়লে কিছুটা ধারণা পাবে তবে পুরোপুরি বুঝবে না। আমরা যারা তাঁর ভাষণ শুনেছিলাম, দূর থেকে হলেও একটু দেখেছিলামÑ আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধুর মতো বাঙালী বার বার আসে না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাঙালীর হৃদয়ে, বলেন তিনি। মাঝ বয়সী সোরহাব উদ্দিন। সরকারী ছুটির দিন হলেও এসেছেন জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম (বঙ্গবন্ধু) লিখে দাও, আর ঠিকানা দিয়ে দাও ধানম-ি ৩২ নম্বর’- এমন কথা যিনি বলতে পারেন তিনি তো মহাপুরুষ। এই তো আমাদের জনক। এমন মহানায়ক পৃথিবীতে আর জন্ম নেবে কিনা আমার জানা নেই। শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, আমরা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সানিধ্য পাইনি। তবে তাঁর আদর্শ মেনেই ছাত্র রাজনীতিতে আসি। তাঁর আদর্শ মেনেই রাজনৈতিক জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময়ের চেয়ে এখন বর্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেটসহ নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে অনেক তথ্য পাচ্ছে। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বনানী কবরস্থানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মা, তিন ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। তাঁদের কবরে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অনেক মানুষ ছুটে যায় বনানী কবরস্থানেও। অনেককেই কবরস্থানে গিয়ে দোয়া করতেও দেখা যায়। এই প্রজন্মের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় স্বাধীনতা নিয়ে তাদের ভাললাগা আবেগের কথাও। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী কাইয়ুম হাসান বলেন, আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, শুনেছি। যুদ্ধের নানা বই পড়ে বা ছবি দেখে কিছুটা অনুভব করেছি। তাই স্বাধীনতা এই বিষয়টির প্রতি আলাদা আবেগ কাজ করে। আর সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামটি আপনাআপনি চলে আসে। বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, দেশ নিয়ে যেমন ভালবাসা, আবেগ আছে তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিথ্যাচার যারা করেন সেই ক্ষোভও রয়েছে তারুণ্যের কণ্ঠে। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জেরিন সুলতানা বলেন, আপনি মনে করতে পারেন আমি দল করি বা ছাত্রলীগ করি। বিষয়টা তেমন না। আমি বলতে চাই বঙ্গবন্ধু হবে সব বিতর্কের উর্ধে। অনেক জায়গায় তাঁকে নিয়ে বিতর্ক করা হয় তখন আমরা এই প্রজন্ম লজ্জা পাই। ঘৃণায় আশপাশে তাকাতে পারি না। যার জন্য স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশ পেলাম তাঁকে নিয়ে কোন সমালোচনা তরুণরা মেনে নিতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন একাধিক তরুণ। এদিকে, মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন অলিতে-গলিতে মাইকে বেজেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। সেই সঙ্গে নানা ধরনের দেশাত্মবোধক গানও। বুধবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে স্থাপন করা হয়েছে হাতে আঁকা সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। অসংখ্য তরুণ-তরুণী যাদের বেশিরভাগই বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া বঙ্গবন্ধুর সেই প্রতিকৃতির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন। কেউ কেউ হাতে আঁকা বড় এই প্রতিকৃতির সঙ্গে নিজের একটি ছবি স্মৃতি হিসেবে তুলে রাখছেন। টিএসসির প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেলো আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর নাম আসছে ঘুরে-ফিরে। আর পাশেই মাইক থেকে ভেসে আসছিল বঙ্গবন্ধুর স্মরণে সেই গানটির সুর...‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই/তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা/আমরা পেতাম এক জাতির পিতা’। জাতির পিতা নেই এটাই সত্যি। তেমনি তিনি আবার আছেনও। তিনি বেঁচে আছেন কোটি বাঙালীর হৃদয়ে। তিনি বেঁচে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বঙ্গবন্ধু একটি নাম নয় একটি প্রতিষ্ঠান, গর্ব নিয়ে বলে তরুণ প্রজন্ম।
×