ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা যুবকটিকে আজ খুবই প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৫ আগস্ট ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধা যুবকটিকে আজ খুবই প্রয়োজন

সেই যুবকটিকে কোথাও দেখি না। দেখতে দেখতে ৪৩টি বছর চলে গেল, সেই যুবকটির সঙ্গে দেখা হয় না। আমরা পরস্পরকে ‘দেশী’ বলে সম্বোধন করতাম। ৪৩ বছর ধরে দেশী বলে আমি আর কাউকেই ডাকি না। আমাকেও এই নামে ডাকে না কেউ। যুবক ও আমারÑ দুজনেরই বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুরে। আমার সদর থানায় আর যুবকের গোপালগঞ্জে। পরস্পরের ‘দেশী’ সম্বোধন ছিল এ কারণেই। ১৯৭৫ থেকে ২০১৮, ৪৩ বছর হয়ত তেমন দীর্ঘ সময় নয়। আবার দীর্ঘও তো বটে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল কত ঘোলা হলো গত ৪৩ বছরে, যুবকটি জানল না। হিমালয় থেকে সুন্দরবনÑবিস্তৃত এই প্রিয় বঙ্গ ভূ-খণ্ডে কত ঘটনা ঘটে গেল। যুবকটি দেখল না। ৪৩ বছর যুবকটির প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনি না। ক্রিকেট ব্যাট হাতে দেখি না তাঁকে। উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চে সদর্পে অভিনয় করতে দেখি না। টিএসসির সবুজ লেনে কিংবা সোসিওলজির ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় শাহান-বাদল-মুনীর-তারেকদের সঙ্গে সরব আড্ডা মারতে দেখি না। অথচ আজকের বাংলাদেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণোচ্ছ্বল সেই যুবকটিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। দীর্ঘ একহারা গড়ন, বাম দিকে সিঁথি করা থাক থাক নেমে আসা মাথাভর্তি একরাশ চুল, চশমার নিচে মায়াবী অদ্ভুত উজ্জ্বল চোখ, সুবিন্যাস পুরুষালি গোঁফের নিচে রহস্যময় হাসি জড়ানো ঠোঁটের যুবকটির প্রিয় ছিল খেলাধুলা-গান-নাটক-হাসিঠাট্টা নির্ভেজাল বাহুবেষ্টিত আড্ডা। যুবকটির নাম শেখ কামাল। শেখ কামাল নামের সেই যুবকটির ভীষণ প্রয়োজন আজ বাংলাদেশে। কামালের সঙ্গে আমার পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্বের সময়সীমা বেশি দিনের নয়। সাত-আট বছরের। সাতষট্টি কিংবা আটষট্টি সালে গোপালগঞ্জ লঞ্চঘাটে আমাদের প্রথম দেখা। এখনকার গোপালগঞ্জে যারা নতুন যাওয়া-আসা করছে তারা সেদিনের লঞ্চঘাট চিনবে না। কলেজের পাশে ছিল লঞ্চঘাট। সম্মেলন উপলক্ষে ফরিদপুর থেকে জেলা পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকর্মী গেছি গোপালগঞ্জে। ঢাকা থেকে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন তখনকার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। তাঁর সঙ্গে ছিল দুই তরুণ। একজন শেখ কামাল, অপরজন রথীন। বিখ্যাত গায়ক রথীন্দ্রনাথ রায়। তাঁরা দুজনই তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। আমিও একই ব্যাচের। পড়ি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। কামাল আর রথীনের সঙ্গে আমি একই দিনে পরিচিত হয়েছিলাম। প্রথম দিন থেকেই কামাল আর আমি পরস্পরকে ‘দেশী’ সম্বোধন শুরু করলাম। যা ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ পর্যন্ত অটুট ছিল। রথীনও সেই একই দিন থেকে আমাকে আমার ঘরের ডাকনাম ধরে ডাকে। কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ সম্মেলনে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে বিমানে সেই স্মৃতি রোমন্থন করে দুই বন্ধুতে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেদিনের সেই দৃশ্য আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। মধুমতি নদীর পাড়ে আমরা অপেক্ষা করছি ঢাকা থেকে আসা লঞ্চের জন্য। ফরিদপুর থেকে আসা আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে তখনকার স্থানীয় ছাত্রনেতা ইসমত কাদির গামা ভীষণ অস্থির অপেক্ষার যন্ত্রণায়। লঞ্চ এলো। প্রধান অতিথি নামলেন। শত কণ্ঠের স্লোগান মধুমতি নদীর ছোট ছোট ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে গেল। হালকা ক্রিম রঙের ফুলপ্যান্ট আর আকাশি হাফশার্ট ছিল সেদিন কামালের গায়ে। মেদহীন লম্বা শরীর, কেমন অদ্ভুত আকর্ষণীয় চোখ। বড় বোন শেখ হাসিনার চোখের সঙ্গে দারুণ মিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি। এরপর অজস্রবার দেখা হয়েছে আমাদের। কত কথা, কত স্মৃতি। অনেক কথা মনে আছে, অনেক কিছু মনে নেই। ইন্টার কলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে ঢাকায় এলেই কামালের সঙ্গে দেখা হতো। একবার মোহাম্মদপুর মাঠে খেলতে গিয়ে ময়মনসিংহ কলেজ আমাদের রাজেন্দ্র কলেজের সঙ্গে অযথাই মারপিট বাধিয়ে বসল। খবর পেয়ে ঢাকা কলেজ থেকে এক দঙ্গল বন্ধু নিয়ে কামাল মোহাম্মদপুর মাঠে হাজির। আমার ছোটকালের বন্ধু, তারাও ছিল কামালের সঙ্গে, স্পষ্ট মনে আছে। ফরিদপুরের জন্য একটু বাড়তি টান ছিল কামালের। একবার ফরিদপুরে লীগ টুর্নামেন্টের ফাইনালে রাজেন্দ্র কলেজের সঙ্গে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া ক্লাবের খেলা। আমি কলেজ টিমের ক্যাপ্টেন। প্রতিপক্ষ আমারই পাড়ার দল। খেলার দিন সকালে মাঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। হঠাৎ বাইরের রাস্তায় শুনি কামালের গলা। চিৎকার করে ডাকছে ‘দেশী, অ দেশী, বাড়ি আছো নাকি?’ গোপালগঞ্জীয় উচ্চারণে তারস্বরে ডেকেই যাচ্ছে। ছুটে বাইরে গেলাম। দেখি সত্যি সত্যিই কামাল। আমার প্রতিপক্ষ দলের হয়ে খেলতে এসেছে ঢাকা থেকে। সঙ্গে অলিউল, তান্না, বাদশা, রকিবুলসহ আরও অনেকে। ক্রিকেট নিয়ে কামালের একটা আলাদা উন্মাদনা ছিল। সেই উন্মাদনাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাকে আবাহনী গড়তে সাহস জুগিয়েছে। কামালের প্রিয় খেলা ক্রিকেট নিয়ে আজ বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ক্রিকেট আজ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বকাপ খেলছে বাংলাদেশ। দেশী, এ সময় তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে। খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগ ডেতে রং খেলারত কামালের চেহারাটা সেদিন বার বার মনে হচ্ছিল আমার। ২৬ মার্চের পর কামালের সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল। অল্প সময়ের জন্য। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরা কামাল আর আমি কোন কথাই বলতে পারিনি সেদিন। স্পেশাল ট্রেনিংয়ের প্রথম ব্যাচে আমাদের একসঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল দেরাদুন। জেলাভিত্তিক কোটায় ফরিদপুর থেকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হই আমি। কঠিন টাইফয়েড হলো আমার। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার পরিবর্তে গেল পাংশার অলীক। কামাল সেতার বাজাত। সেতারসহ কামালের ছবি দেখেছি। কামালের হাতে সেতার শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়। আজকের বাংলাদেশে তরুণ প্রজšে§র কাছে ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের উদ্যোক্তা সম্ভবত শেখ কামাল। ‘স্পন্দন’ নামে একটা জনপ্রিয় গ্রুপও তৈরি হয়েছিল কামালের হাতে। সেই সময়কার একটা জনপ্রিয় গান ‘এমন একটা মা দেনা যে মায়ের সন্তানেরা কান্দে আবার হাসতে জানে।’ কিংবা ‘এ্যাতো সুন্দর দুনিয়া কীসের লাগিয়া’ অথবা ‘মন তুই জানলিনারে বুঝলিনারে’ ইত্যাদি। তখনকার ওই স্পন্দনের বিটে বিটেই স্পন্দিত আজকের ব্যান্ডসঙ্গীত। দেশী, এ সময় তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে। খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমাকে। কামাল একবার আমার ওপর মনঃক্ষুণœ হয়েছিল। ডাকসু নির্বাচন তখন সমাসন্ন। সকালের দিকে কামাল স্বশরীরে এসে উপস্থিত জগন্নাথ হলে আমার কক্ষে। আমি তো অবাক। কোন ভূমিকা ছাড়াই কামাল জানাল, আমাকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে হবে। আমি আমার অপারগতা ও অক্ষমতার কথা বললাম। আমি তখন সক্রিয়ভাবে ছাত্রসংগঠন করি না। তাছাড়া রাজনীতি বিষয়ে আমি ততদিনে নিজস্ব কিছু দর্শন, নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ধারণ করে ফেলেছি। খুবই মনোক্ষুণœ হলো কামাল। পরে জগন্নাথ হলের নৃত্যশিল্পী কমল সরকারকে মনোনয়ন দেয়া হলো। মঞ্চনাটকের সফলতা নিয়ে আজ আমরা গর্ব করি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিল্প মাধ্যমের যে শাখাটি আপন কর্মপ্রচেষ্টায় সবচেয়ে শক্ত অবস্থান অর্জন করেছে, সেটি নাটক, গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বেড়ে ওঠা এই শিল্প মাধ্যমটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে সিকি শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। হাজার হাজার নিরলস কর্মী সারাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় রক্ত-ঘামের শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এই নিঃস্বার্থ কর্মীদের ক’জন জানে যে বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পথিকৃৎদের একজন শেখ কামাল। সম্ভবত বেশিরভাগ নাট্যকর্মীরই জানা নেই যে, কামাল মঞ্চে সু-অভিনয় করত। নিয়মিত রিহার্সেল দেয়া, সহশিল্পীদের চেয়ে আগে রিহার্সেল রুমে পৌঁছানো, সেট নির্মাণে সহায়তা করা, দর্শকের জন্য চেয়ার সংগ্রহ করা ইত্যাদি গ্রুপ থিয়েটারের খুঁটিনাটি বিষয়ে কামালের অংশগ্রহণ ছিল ঈর্ষণীয়। এখনকার প্রজন্মের কর্মীদের কাছে শেখ কামালের এই পরিচয় না জানাই স্বাভাবিক। কারণ, যাঁরা বাংলাদেশে নাট্যচর্চা নিয়ে অনেক অনেক কথা বলেন, লেখেন, বক্তৃতা দেন তাঁরা তো নাটকের সঙ্গে কামালের সম্পৃক্ততা নিয়ে সামান্য কিছুও বলেন না। লেখেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা থিয়েটারের সদস্য। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমাদের প্রথম প্রযোজনা পরিত্যক্ত হয়ে যেত যদি কামাল নিজে উদ্যোগ নিয়ে দর্শকদের বসার চেয়ার সংগ্রহ করে না দিত। সবধরনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আসাদ ও আমি যখন রাতে ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়ে ক্লান্ত কামালকে সমস্যার কথা জানালাম তখন সে একটুও বিরক্ত হয়নি। এ সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। নাট্যচক্রে কামাল অভিনয় করেছে বেশ কয়েকটি নাটকে। উল্লেখযোগ্য অভিনয় আমার মতে ‘দানব’ নাটকে। কলাভবনের সামনে বিরাট মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করে নাটকটির মঞ্চায়ন হয়েছিল। ওই নাটকটিতে আমি কামালের সহশিল্পী ছিলাম। মনে পড়ে, নাটক শেষে যে-ই ওর অভিনয়ের প্রশংসা করছিল তাকেই খুশি হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরছিল। খুব অল্পতে খুশি হতো, খুব অল্পতে আঘাতও পেত। চিন্তিত, বিষণœ শেখ কামালকে আমি কোন দিন দেখিনি। এটা সৌভাগ্য। দেখতে দেখতে ৪৩ বছর চলে গেল। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কত জল ঘোলা হলো, জলের নিচে কত চোরাঘূর্ণি গ্রাস করল কত স্বপ্ন। কত ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে জেগে থাকে আমার করোটি। কত কিছু দেখতে দেখতে ঝাপসা হয়ে আসে আমার চোখ। এত কিছু দেখি। এত ভুল মুখ। অথচ উচ্ছল তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক, শুদ্ধ যৌবনের প্রকৃত দূত মায়াবী চোখের যুবকটিকে কোথাও দেখি না। গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক উচ্চারণ মেশানো প্রাণখোলা ‘দেশী’ ডাক আর শুনি না। সেই যুবকটিকে খুবই প্রয়োজন আজ। খেলাধুলায়, সঙ্গীতে, নাটকে, আড্ডায়, হৈহুল্লোড়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির বিষদাঁত উপড়ে দিতে শেখ কামাল নামের মুক্তিযোদ্ধা যুবকটিকে আজ খুবই প্রয়োজন। লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক
×