ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুততম সময়ে ৫ লাখ টন আমদানির প্রক্রিয়া শুরু

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে লবণ সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা!

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৫ আগস্ট ২০১৮

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে লবণ সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা!

এম শাহজাহান ॥ কোরবানি সামনে রেখে লবণের সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে জরুরী ভিত্তিতে লবণ আমদানির অনুমতি দিতে যাচ্ছে সরকার। উৎপাদন, মজুদ ও চাহিদা বিবেচনায় এ বছর ৫ লাখ টন লবণ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। চামড়া রক্ষায় কোরবানি ঈদের আগেই যাতে লবণ আমদানি হতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে বিসিক। জানা গেছে, চাহিদা বাড়লেও উৎপাদনের জমির হ্রাস পাওয়ায় প্রতিবছর দেশে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানায় লবণের চাহিদা বাড়ছে। বছরে ২০ লাখ টনের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় সাড়ে ১৪ লাখ টন। ফলে সাড়ে ৫ লাখ টন ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিবছর কোরবানির আগে লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। এ বছর আমদানি অনুমতির আগে লবণের দাম একদফা কেজিতে ২-৩ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে। বর্তমান প্রতিকেজি লবণ মানভেদে ২৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। আগামী কোরবানির আগে দেশে লবণের সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লবণের দাম বাড়ানোর কারসাজি শুরু করেছে একটি চক্র। লবণ আমদানির অনুমতি প্রদানের জন্য সম্প্রতি বিসিক থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সম্প্রতি চলতি বছরের লবণ উৎপাদনের হিসাব নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, ট্যারিফ কমিশনও লবণের মজুদ, বাজার পরিস্থিতি, উৎপাদন, চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমদানির পাশাপাশি দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ টন লবণ অবৈধভাবে আনা হয়ে থাকে। এদিকে ২২ আগস্ট কোরবানি ঈদের সম্ভাবনা। ওই হিসেবে আর মাত্র ১৫ দিনের মতো সময় আছে। ওই সময় কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বিপুল লবণের প্রয়োজন হবে। মূলত ব্যবসায়ীরা এই চাহিদা পুঁজি করেই প্রতিবছর কোরবানি ঈদের আগে লবণ নিয়ে কারসাজি ও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করে থাকে। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশে লবণ আনতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাসের সময়ের প্রয়োজন। এ কারণে কোরবানির আগে দেশে আমদানিকৃত লবণ আনা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে আশঙ্কা রয়েছে। এই বাস্তবতায় লবণের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা ব্যবসায়ীরা। লবণ মালিকরা বলছেন, উৎপাদনের জমি প্রতিবছর ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে। লবণ উৎপাদন এলাকা মহেশখালী-মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র এলএনজি টার্মিনাল এবং অন্যান্য শিল্প গড়ে ওঠার কারণে লবণ উৎপাদনের জমি সংকুচিত হয়ে আসছে। তাদের মতে, দেশে বর্তমান ৫০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। যদিও বিসিকের তথ্যমতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে ৬০ হাজার একর জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ লবণ মিল সমিতির তথ্যমতে, দেশে লবণের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান শিল্প উন্নয়ন বিশেষ করে চামড়া শিল্প, ডিটারজেন্ট শিল্প, ডাইং প্রিন্টিং, হোটেল শিল্প, ওষুধ শিল্প বেভারেজ শিল্প আচার, মুড়ি, চানাচুর, বেকারি ও পাওয়ার প্লান্ট প্রভৃতি খাতে লবণের প্রয়োজন প্রায় ৭ লাখ টন। প্রাণিসম্পদ ও হর্টিকালচার খাতে ৩ লাখ টন, মৎস্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ৫০ হাজার টন, ভোজ্য লবণ ৯ লাখ টন এবং বরফ, পোল্ট্রি ফিড ও অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার টন লবণের চাহিদা রয়েছে। এ হিসাবে বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এদিকে বিসিকের তথ্যমতে দেশে লবণের চাহিদা ১৪ লাখ টন। এর মধ্যে শিল্প খাতে পৌনে চার লাখ এবং ৮ লাখ ৭২ হাজার টন ভোজ্য লবণের চাহিদা দেশে রয়েছে। তাদের এই তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি ও ট্যারিফ কমিশন। ফলে দেশে লবণের চাহিদা ও ঘাটতির তথ্য নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ে লবণ সংক্রান্ত এক জরুরী বৈঠকে অতিরিক্ত সচিব সালাহউদ্দিন মাহমুদ বলেন, লবণ শিল্পের সঙ্গে অনেক লোক জড়িত। সেজন্য এ খাতকে সহযোগিতা করা এবং এ খাতের যুক্তিযুক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। দেশে লবণের যাতে কোন সঙ্কট তৈরি না হয়ে সে বিষয়ে সবার সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, কস্টিক সোডা উৎপাদনের নামে সোডিয়াম সালফেটসহ অন্যান্য শিল্প লবণ আমদানি করে ভোজ্য লবণ হিসেবে বাজারজাত করা নৈতিকতা বিরোধী কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই বৈঠকে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা বলেন, দেশে ৪-৫ লাখ টন লবণ অবৈধভাবে আনা হয়ে থাকে। এটা বন্ধ করে সঠিক পন্থায় আমদানির পরামর্শ দেয় ট্যারিফ কমিশন। বাংলাদেশ লবণ মিল সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বৈঠকে বলেন, গত বছর লবণ আমদানির অনুমতিপ্রাপ্ত সকল মিল মালিকই আমদানিকৃত লবণ কারখানায় উত্তোলনপূর্বক যথাযথভাবে বাজারজাত করে তথ্যাদি কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করেছেন। কিন্তু মিল মালিকরা এখনও জামানত ফেরত পাননি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন তিনি। তিনি বলেন, গ্রামগঞ্জের বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটা লবণ সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগই আয়োডিনযুক্ত, মানসম্পন্ন এবং দামও তুলনামূলক কম। লবণ আমদানি করা হলে পূর্বের নিয়মে লবণ আমদানির অনুমতি প্রদানের পক্ষে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, যারা বিধিবহির্ভূত কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে সরকার। বিসিক চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান বলেন, লবণের হাল নাগাদ চাহিদা ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে লবণ আমদানি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে যুক্তযুক্ত। তিনি বলেন, লবণের বাজার মূল্য বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করা হচ্ছে। এ অভ্যাস থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার মনোভাব তৈরি করতে হবে। অবৈধভাবে সোডিয়াম সালফেট আমদানি রোধে বিসিক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একত্রে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, এ খাতকে সহযোগিতা করা এবং এ খাতের যুক্তিযুক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কস্টিক সোডা উৎপাদনের নামে সোডিয়াম সালফেটসহ অন্যান্য শিল্প লবণ আমদানি করে ভোজ্য লবণ হিসেবে বাজারজাত করা নৈতিকতাবিরোধী কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটা বন্ধ করতে সবাইকে সচেতন থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
×