ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের নেপথ্যে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও দলীয় ঐক্য

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১ আগস্ট ২০১৮

বিজয়ের নেপথ্যে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও দলীয় ঐক্য

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট ॥ সিলেট সিটি নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। শুধু ভোট বর্জনই নয়। বর্তমান কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলে দেখা গেল আরিফুল হক চৌধুরীই নিশ্চিত মেয়র হতে চলেছেন সিলেট নগরীতে। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু না হলে আরিফুল হক কোনভাবেই বিজয়ী হতে পারতেন না। যদিও এখন পর্যন্ত এই সিটির ফল ঘোষণা করা হয়নি। তারপরেও সুষ্ঠু নির্বাচনের কারণে তিনি নিশ্চিত বিজয়ের পথেই রয়েছেন। তিন সিটি করপোরেশনের মধ্যে রাজশাহী এবং বরিশাল আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করলেও সিলেটে বিজয়ী হতে চলেছেন বিএনপি প্রার্থী। যদিও দুই স্থগিত কেন্দ্রের ভোটের ব্যবধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধানের চেয়ে বেশি হওয়ায় ফল ঘোষণা করেনি রিটার্নিং কর্মকর্তা। দুই কেন্দ্রে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও জানিয়েছেন তিনি। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে সুষ্ঠু নির্বাচনের কারণেই সিলেটে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। শুধু সিলেট নয় তিন সিটির ফল বিশ্লেষণেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এই নির্বাচনের প্রার্থীর জয়ের মূল অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে দলীয় ঐক্য, উন্নয়নের পক্ষে রায়, তরুণ এবং নারী ভোটারদের আস্থা এবং ব্যক্তিগত আচার ব্যবহার। তেমনি প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে কাজ করেছে দলের মধ্যে অন্তঃকোন্দল, মেয়র থাকাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা এবং ব্যক্তিগত রূঢ় ব্যবহার। রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন যেমন তরুণ এবং নারী ভোটারের কাছে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া উন্নয়নের পক্ষে কথা বলা, পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে তার পক্ষে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়েছে। অপর দিকে বরিশালে তরুণ ভোটারের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন সাদিক আব্দুল্লাহ। দলীয় ঐক্য না থাকার কারণেই সিলেটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে। তেমনি সংগঠিত দলীয় নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণের কাছে জনপ্রিয়তার কারণেই সিলেটে মেয়র হতে চলেছেন আরিফুল হক চৌধুরী। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহম্মেদ কামরানের পক্ষে দলীয় নেতাকর্মীরা জোরালো কাজ করেনি। তারা প্রকাশ্যে প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও ভেতরে ভেতরে বিপক্ষে কাজ করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করার কারণেই তার পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠনিকভাবে এই সিটির ফল ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু ভোটের হিসাব-নিকাশ বলছে বিএনপির এই সিটিতে মেয়র পদে জয়লাভ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিএনপির প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে আছেন ৪ হাজার ৬শ’ ২৪ ভোটের ব্যবধানে। অপর দিকে স্থগিত দুটি কেন্দ্রে ভোট রয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৭৮৭। বিএনপি প্রার্থীকে জিততে হলে আর মাত্র ভোটের প্রয়োজন ১৬৩ ভোট। জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে এই পরিমাণ ভোট পাওয়া আরিফুলে পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। অপর দিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিততে হলে দুই কেন্দ্রে সব ভোটই তার পক্ষে নিতে হবে। কিন্তু নির্বাচনে একশ’ভাগ ভোট পড়লেই কেবল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জেতা সম্ভব। যা কখনো হবার নয়। যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদর উদ্দিন কামরান ভোটে পিছিয়ে থেকে এবার বিএনপির সুরেই নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। তিনি দুই স্থগিত কেন্দ্রেই নয় ১৮টি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। অপর দিকে নির্বাচন শেষে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন আরিফুল হক। শেষ পর্যন্ত বিজয়ের আভাস পাওয়ার পর তিনি ভোল্ট পাল্টে ফেলেন। সুর পাল্টে বলেন এটা জনগণের বিজয়। ভোট নিয়ে তার দ্বিমুখী আচরণ সত্ত্বেও নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৫ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকার মাধ্যমে। রাজশাহী এবং বরিশাল সিটি নির্বাচনের বিএনপির ভোট কারচুপি এবং জালভোটের অভিযোগ করলেও তারা সিলেট নির্বাচন নিয়ে এখন আর সমালোচনা করছে না। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজশাহী এবং বরিশালে পুনরায় ভোট গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সিলেটে নতুন করে ভোট দাবি না করলেও এর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, একমাত্র সিলেটে এখন পর্যন্ত ফলাফলটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেখানে বিএনপির যে প্রার্থী ছিলেন এবং আমাদের দল যেখানে তারা একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল বলেই কিন্তু সব জায়গায় তারা সব কিছু করতে পারেনি। ভোট ‘ডাকাতি’ না হলে তিন সিটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হতেন বলে দাবি করেন মির্জা ফখরুল। এদিকে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ের যেমন রয়েছে মানুষের কাছে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেয়া। এছাড় তরুণ ও নারী ভোটারদের সম্পৃক্ততা ও আস্থা অর্জনের কারণে দ্বিগুণের বেশি ভোটে জয়লাভ করেছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। শুরু থেকেই মাঠে সক্রিয় থেকে উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেয়ার কারণে লিটনের সফলতা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করছেন নগরবাসী। এছাড়া রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, পারিবারিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সফলতা এনে দিয়েছে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে। মূলত এবার রাজশাহী নগরবাসী প্রার্থী বেছে নিতে ভুল করেনি। একযোগে উন্নয়নের প্রত্যাশায় খায়রুজ্জামান লিটনকে ভোট দিয়েছে। অপর ফল বিশ্লেষণে বিএনপির প্রার্থীর ভরাডুবির নেপথ্যেও একাধিক কারণ জড়িত রয়েছে। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ছিলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশন সদস্য সাবেক মেয়র। তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালনে ব্যাপক ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও দলীয় তীব্র অন্তর্কোন্দল, রাজনৈতিক ব্যর্থতা, জামায়তের সঙ্গ না পাওয়া, কর্মী সঙ্কট এবং প্রচারণায় বুলবুলের রূঢ় আচরণ পরাজয়ের নেপথ্য হিসেবে কাজ করছে। নানা গুজব ছড়িয়ে আর অপপ্রচার চালিয়ে রাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে জেতার চেষ্টায় মরিয়া ছিলেন বুলবুল। কিন্তু ফল ঘোষণার পর দেখা গেল সেসব অপপ্রচার কোন কাজেই আসেনি। রাজশাহীর উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে ভোটাররা এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বুলবুলের থেকে। রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মানুষ উন্নয়নের পক্ষে থাকতে চায়। রাজশাহীবাসীও তাই চেয়েছে এবং যোগ্য প্রার্থী হিসেবে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে ভোট ঢেলে দিয়েছে। লিটনের অতীত উন্নয়নের কারণে মানুষ আবার তাকেই চেয়েছে। একবার রাজশাহীবাসী ভুল বুঝলেও এবার সে ভুল করেনি। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে রাজশাহীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং উন্নয়নের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রায় দিয়েছে। তিনি বলেন, গত ৫ বছরে মেয়র থাকাকালীন বিএনপির মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাজশাহীবাসীর জন্য কিছুই করতে পারেনি। নগরভবনকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল। নাগরিক সেবা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। লিটনের সাজানো নগরী পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করেছে। এমনকি রাসিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা না দিতে পেরে গা-ঢাকা দিয়েছিল। এসব কারণে রাজশাহীর মানুষ বুলবুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবার। নগরবাসী এবং ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিয়ে ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশনে প্রথমবারের মতো মেয়র হয়েছিলেন বুলবুল। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পাঁচ বছরে ব্যর্থ ছিলেন বুলবুল। বরং ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল নগরবাসী। নগরীর অধিকাংশ সড়ক ছিল ভাঙ্গাচোরা। বুলবুল মেয়র থাকাকালে নগরীর দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন কাজও হয়নি। এসব কারণে অসন্তোষ ছিল নগরবাসী। এছাড়া নানা অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত থাকায় বেশ কিছুদিন কারাগারেও থাকতে হয় বুলবুলকে। এতে করে জনগণের বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়। তাই নির্বাচনী প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসে ১৮ দফার ইশতেহার ঘোষণা করলেও ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি বুলবুল। এছাড়াও রাজশাহীতে বিএনপির হেভিওয়েট নেতাদের অন্তর্কোন্দল বুলবুলের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। দলীয় কোন্দলের কারণে রাজশাহী বিএনপির হেভিওয়েট নেতারা ভোটের মাঠে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু ও বুলবুলের কোন্দল ছিল গত বছরের ডিসেম্বর থেকে। মিজানুর রহমান মিনুকে বাদ দিয়ে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে মহানগরের সভাপতি ঘোষণা করা হলে মিনুপন্থীরা বুলবুলের কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দলীয় কার্যালয়ে তালাও মেরে দেয়। বুলবুলের পক্ষে মিনু নামকাওয়াস্তে মাঠে থাকলেও মিনুপন্থিরা ছিল একেবারে নিষ্ক্রিয়। এছাড়াও এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শরিক দল জামায়াতকে পাশে পায়নি বুলবুল। বুলবুলের পরাজয়ের নেপথ্যে জামায়াতের মুখ ফিরিয়ে নেয়াও ছিল একটি কারণ। একই কারণে এবার হেরেছে জামায়াতের ১৪ কাউন্সিলর প্রার্থীর সবাই। এবারের মেয়র নির্বাচনেও শুরু থেকেই ব্যাপক কর্মী সঙ্কটে ছিল বিএনপি। নির্বাচনী ওয়ার্ডগুলোতে কর্মী সঙ্কটের কারণে কোন টিম গঠন করতে পারেনি বুলবুল। মাঠে ছিল না ছাত্রদল যুবদলের নেতাকর্মীরাও। নির্বাচনী ব্যানার-পোস্টার টাঙানোর জন্যও বুলবুলের কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর তুলনায় প্রচারে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন বুলবুল। প্রচারে গিয়ে বারবার মেজাজ হারিয়েছেন তিনি। নিজের কর্মীদের পাশাপাশি ভোটারদের সঙ্গেও রূঢ় আচরণ করতেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে রাজশাহীতে বুলবুরকে দ্বিগুণ ভোটের ব্যবধানে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে।
×