ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি ও কুরিয়ারে ইয়াবার টাকা লেনদেন’

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৫ জুলাই ২০১৮

‘মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি ও কুরিয়ারে ইয়াবার টাকা লেনদেন’

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিদিন ইয়াবা বিক্রির কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে কক্সবাজারে। বিশেষ করে শহরের একটি প্রসিদ্ধ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা প্রদান করে চলেছে গোপনে। প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে অনেক সময় কাউন্টারে টাকা বিলি না করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ইয়াবার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসছে তাদের প্রতিনিধিরা। মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতা দেখে ইয়াবা গডফাদাররা ইয়াবার চালান প্রেরণ ও টাকা পরিশোধে বেছে নিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং ও কুরিয়ার সার্ভিসকে। এতে নিরাপদে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা কারবারিরা তাদের অবৈধ কারবার। জানা গেছে, কক্সবাজার সদর, উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও চকরিয়ায় মোবাইল ব্যাংকিং (এজেন্ট) ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক গড়ে উঠেছে হুন্ডি ব্যবসা। সেখানে রয়েছে অন্তত ৫০টিরও বেশি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট। ওসব মোবাইল ব্যাংকিংসহ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিদিনের লেনদেন প্রায় কয়েক কোটি টাকা বলে সূত্রে জানা গেছে। ইয়াবা কারবারিরা নিজের ও স্বজনদের নামে অসংখ্য সিম কিনে ব্যাংকিং সুবিধাকল্পে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সিম কিনে তারা স্বজনদের নামের আইডিকার্ড নম্বর দিয়ে খুলেছে ব্যাংকিং সুবিধা। তাছাড়া নিজেদের সুবিধার্থে নিজস্ব লোকজনকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সিম কিনে দোকান খুলে বসিয়ে দিয়েছে। ওসব সিম থেকে প্রতিদিন লেনদেন করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রতিবারে ১০ হাজার টাকা হারে পাঠানো হয়ে থাকে ব্যক্তিগত সিমে। তবে বেশি টাকা কয়েকবার করে পাঠানো হয়ে থাকে ওসব এজেন্টদের কাছে। ইয়াবা বিক্রির টাকা যদি মোটা অঙ্কের হয়, তা হলে পাঠানো হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। ব্যাংকে ঝামেলা এড়াতে এবং প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে কুরিয়ার সার্ভিস ও মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনই নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা। কক্সবাজারে বহু এজেন্টও সরাসরি ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শহরের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের জনৈক কর্মকর্তা ও কতিপয় কর্মচারী একাধিকবার ইয়াবার চালান পার্সেলের মাধ্যমে গোপনে পাঠিয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইতোপূর্বে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ওই কুরিয়ার সার্ভিস কাউন্টার থেকে পৃথক দুইটি চালান জব্দ করেছে। রহস্যজনক কারণে পার্সেল বুকিংকারী কুরিয়ার সার্ভিসের স্টাফ কাউকে আটক করা হয়নি। বর্তমানে ওই কুরিয়ার সার্ভিসে ইয়াবার মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করতে দৈনিক মেমো বা রেজিস্টারভুক্ত করা হচ্ছে না। প্রশাসনের লোকজন যাতে কিছুই খুঁজে না পায়, এজন্য গোপন ডায়েরিতে শুধু প্রাপক-প্রেরকের নাম ও টাকার সংখ্যাটা লিখে গোপনে টাকা প্রদান করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ইয়াবা বিক্রি বাবদ কোটি কোটি টাকা মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢুকছে কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সূত্র জানায়, কতিপয় হুন্ডি ব্যবসায়ীর দোকান রয়েছে কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের যে কোন প্রান্ত থেকে ইয়াবা বিক্রির টাকা পাঠাতে তারা মুঠোফোনে শুধু একটি সাঙ্কেতিক চিহ্ন এবং টাকার অঙ্কে গিয়ে এক টাকা ও এক শ’ টাকার কথাই বলে থাকে। অর্থাৎ ইয়াবা কারবারিদের কাছে এক হাজার টাকার সাঙ্কেতিক শব্দ হচ্ছে ১ টাকা। এক লাখ টাকায় এক শ’ টাকা এবং এক কোটি টাকার স্থলে ১ হাজার টাকা। মুঠোফোনে অপর প্রান্ত থেকে ইয়াবা লেনদেন বাবদ বিক্রেতাকে টাকা পরিশোধের জন্য তার হুন্ডি ব্যবসায়ীকে বলে থাকে ‘অমুককে’ পাঁচ শ’ টাকা দিতে হবে। তাই হুন্ডি ব্যবসায়ী কাক্সিক্ষত ইয়াবা কারবারির হাতে ৫ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। আর মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের কাছে গিয়ে শুধু লাস্ট নম্বর ও টাকার সংখ্যাটি বলে দিলেই চলে। সঙ্গে সঙ্গে টাকা পরিশোধ হয়ে থাকে। এভাবে চলছে কক্সবাজারে ইয়াবা বিক্রি বাবদ টাকা লেনদেন ও ইয়াবার কারবার। এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর আশ্রিত ক্যাম্প এলাকায় তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আগে উখিয়া টেকনাফে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। বর্তমানে টেকনাফ উখিয়ার ক্যাম্প এলাকায় প্রায় শতাধিক হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের দোকান গড়ে উঠেছে। ওসব এজেন্ট দোকানে পৌঁছানো হয়ে থাকে সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের টাকা। তারা নিয়মিত হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে ওসব এজেন্টদের কাছে। বহু রোহিঙ্গাও ইয়াবা বিক্রির টাকা লেনদেন করছে ওই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। জানা গেছে, গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে ইয়াবা কারবারিরা একেকদিন একেক জায়গা থেকে ইয়াবার টাকা উত্তোলন করে থাকে। স্থানীয়রা বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং গরিবদের জন্য সুবিধাজনক ও সেবামূলক ব্যবস্থা ছিল। গৃহকর্তা কোথাও অবস্থান করলে, শ্রমিকের কাজ নতুবা চাকরি করলে টাকার প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ চাহিদা মেটাতে ব্যয়ভার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো যেত। এমনকি তফসিলি ব্যাংকগুলো বন্ধের পর রাতেও মোবাইল ব্যাংকিং থেকে টাকা উঠানো যেত। তবে গরিবের এ সেবাটিও নষ্ট করে দিয়েছে ইয়াবা কারবারিরা। সচেতন মহল বলে, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিস ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধুমাত্র কক্সবাজারে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো বন্ধ ঘোষণা করা দরকার হয়ে পড়েছে। তবে গরিব লোকজনের সুবিধার্থে জরুরী মুহূর্তে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিং করার অনুমতি রেখে একই আইডির বিপরীতে একাধিক সিম বন্ধ করা যেতে পারে। শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কক্সবাজারে ইনকামিং মোটা অঙ্কের টাকা বন্ধ ঘোষণা করলে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা বেকায়দায় পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে ইয়াবা বিক্রি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তারা। তাছাড়া কক্সবাজার জেলায় কার কার নামে মোবাইল ব্যাংকিং খোলা আছে, তাদের দৈনিক, সপ্তাহিক ও মাসিক লেনদেন কত? প্রশাসনের তল্লাশির মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরগুলোর তালিকা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এতে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে ইয়াবা কারবারিদের নাম ও ঠিকানা। কুরিয়ার সার্ভিসে খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে ইতোপূর্বে কার নাম ও নাম্বারে কত লাখ টাকা অবৈধভাবে কক্সবাজারে এসেছে।
×