ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

গণতন্ত্রের অগস্ত যাত্রা!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৪ জুলাই ২০১৮

গণতন্ত্রের অগস্ত যাত্রা!

গণতন্ত্র কি সঙ্কটে পড়েছে? কয়েক দশক ধরে বিজয়কেতন উড়িয়ে চলার পর গণতন্ত্র কি এখন পিছু হটতে শুরু করেছে? প্রশ্ন উঠছে এ জন্য যে বেশকিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে যা থেকে বলা যায় যে গণতন্ত্র আজ আর আগের অবস্থায় নেই। তার শরীরে বিভিন্ন রোগ এসে বাসা বেঁধেছে। তা নইলে এমন হবে কেন যে পৃথিবীতে গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গণতন্ত্রের রীতিনীতিগুলোকে সমানে পদদলিত করে চলেছেন। কর্তৃত্ববাদী সামনের দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশকে এক ব্যক্তির শাসনের দিকে নিয়ে গেছেন। দেশে দেশে আবির্ভূত হচ্ছে লৌহমানবদের শাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ২ লাখেরও বেশি লোককে কারাগারে পাঠিয়ে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে তার পরও গত ২৪ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন এবং সুলতানদের মতো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ভøাদিমির পুতিন তো রাশিয়ার নতুন এক নায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। স্বাস্থ্যগত লক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর থেকে গণতন্ত্রের আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটেছে। গণতন্ত্র হয়ে পড়েছে রুগ্ন, কোথাও বা মুমূর্ষু। এক সমীক্ষায় দেখা যায় ২০১৭ সালে ৮৯টি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছে, মাত্র ২৭টি দেশে এর উন্নতি হয়েছে। তরুণ আমেরিকানদের এক-তৃতীয়াংশেরও কম মনে করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাস করা অপরিহার্য নয়। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এ বছর গণতন্ত্রের অপমৃত্যু নিয়ে লেখা বেশকিছু বই আত্মপ্রকাশ করেছে। তার একটির শিরোনাম ‘হাউ ডেমোক্রেসি এ্যান্ডস।’ গণতন্ত্রের এই উল্টোপথে হাঁটার ব্যাপারটা সাম্প্রতিক ঘটনা। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গণতন্ত্রের লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছিল। ১৯৪১ সালে মাত্র ডজনখানেক দেশে গণতন্ত্র ছিল। ২০০০ সাল নাগাদ মাত্র ৮টি দেশে কখনই নির্বাচন হয়নি। ৩৮টি দেশে এক সমীক্ষায় দেখা যায় প্রতি ৫ জন লোকের ৪ জন গণতান্ত্রিক শাসনে বাস করতে বেশি পছন্দ করে। বাঞ্ছনীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি হুমকি সব দেশে একই প্রকৃতি বা চরিত্রের নয়। আমেরিকার মতো পরিণত গণতন্ত্রের ভারসাম্যের ব্যবস্থা এতই প্রবল যে তা সর্বাধিক ক্ষমতালিপ্সু প্রেসিডেন্টেরও রাশ টেনে ধরে রাখে। অপরিণত গণতন্ত্রের দেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলো এতই দুর্বল যে লৌহমানবরা সহজেই সেগুলোকে পদদলিত করতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশে বেশ দ্রুতগতিতেই গণতন্ত্রের অবক্ষয় হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো উদীয়মান বিশ্বের নবীন ও ভঙ্গুরপ্রায় গণতন্ত্রের দেশ। যেমন ভেনিজুয়েলা থেকে হাঙ্গেরী পর্যন্ত দেশ দোকানগুলোতে এ ব্যাপারে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যাবে। নবীন গণতন্ত্রকে চার পর্যায়ে নস্যাত করে দেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ঘটে স্ট্যাটাসকো নিয়ে জনগণের সত্যিকারের অভিযোগ ও অসন্তোষের বহির্প্রকাশ। তুরস্কের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠরা সেক্যুলার এলিট শ্রেণীর দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে মনে করে এবং সেই কারণে বর্তমান ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট। দ্বিতীয়ত যারা একনায়ক বা স্বৈরাচারী হতে চান তারা শুধু ভোটারদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুতিন পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রকারীদের দোহাই পাবেন। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো তার দেশের সঙ্কটের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেন। হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওবরান তার দেশের সমস্যার জন্য দায়ী করেন জর্জ সোয়াসকে। তৃতীয়ত জনগণের মাঝে ভয়ভীতি বা অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসার পর লৌহমানবরা উদার গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা খর্ব করে। এ সবই করা হয় জনগণের শত্রুদের বিরুদ্ধাচারণ করার নামে। সৎ বিচারপতিদের অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং তারপর তাদের সরিয়ে ক্রীড়নকদের বসানো হয়। স্বাধীন প্রচার মাধ্যম ও টিভি কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় কর বিভাগের লোকদের এবং এভাবে মালিকদের নিজেদের বিক্রি হতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই ব্যক্তির অধিকার ও আইনের শাসন ক্ষুণœ করা হয়। তার পরও লৌহমানব ও একনায়করা নিজেদের ইচ্ছামতো অবাধ নির্বাচনে জয়লাভের নামে গণতন্ত্রীর লেবাস ধারণ করার সুযোগ পায়। চতুর্থ পর্যায়ে উদার ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয় হতে হতে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে গণতন্ত্র সবদিক দিয়েই মৃত্যুবরণ করে শুধুমাত্র নামেই টিকে থাকে। নিরপেক্ষ নির্বাচন তদারককারীদের ঘুম বন্ধ করে ফেলা হয়, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের কারারুদ্ধ করা হয়, সংবিধান বদলে ফেলা হয় এবং চরম ক্ষেত্রে আইন পরিষদকে নখদন্তহীন নপুংশকে পরিণত করা হয়। এক দশক আগেও তুরস্কে গণতন্ত্রের রমরমা অবস্থা ছিল। এখন তা দ্রুত একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৬ সালে সেখানে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর শুদ্ধি অভিযান হয়েছে। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ইসলামী গোষ্ঠী গুলেনপন্থী আন্দোলনের সদস্য বা সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ২ লাখেরও বেশি লোককে হয় গ্রেফতার নয়ত চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। লাখ লাখ তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভয়ে ভীত। কিন্তু তার পরও গত ২৪ জুনের নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। নিজ ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করে তুলেছেন। সংবিধান সংস্কারের দ্বারা তার পদটিকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এখন তিনি আইনের মতো শক্তিশালী ডিক্রিবলে দেশ শাসন করতে পারবেন। বিচার বিভাগকে তার অনুগত লোকদের দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাটেলসম্যান ফাউন্ডেশন’-এর জরিপ তথ্য অনুযায়ী গণতন্ত্রের গুণগতমান গত ১২ বছরে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। উদার গণতন্ত্রের জায়গায় অনুদার গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটছে। উদার গণতন্ত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থাকে। রাজনীতিকরা শুধু যে ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে তা নয়, উপরন্তু আদালত, সাংবাদিক ও প্রেশার গ্রুপগুলোর তীক্ষè নজরদারির মধ্যেও থাকে। এই ব্যবস্থায় বিরোধী দলগুলো সরকারকে বৈধ বলে স্বীকার করে। তবে এর অনেক কার্যকলাপকে সমর্থন করে না এবং পরবর্তী নির্বাচনে সেই সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে শাসক দল ও রাষ্ট্রের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকে। এই ব্যবস্থাটাই এখন সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশে ভোটাররা এমন নেতাদের নির্বাচিত করছে যাদের উদার গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই। তারা ক্রমশ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিয়ে অনুদার গণতন্ত্রের পথ রচনা করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে পর্যাপ্ত ভারসাম্যগুলো সরিয়ে ফেলা হলে স্বৈরাচারের আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তখন ভাবি একনায়কের পক্ষে বিরোধী দলকে টুঁটি টিপে ধরে এবং আইনসভাকে নির্বিষ করে গণতন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা সহজ হয়। যেমনটি হয়েছে তুরস্কে ও ভেনিজুয়েলায়। পাশ্চাত্যের পরিণত গণতন্ত্র এখনও তেমন গুরুতর হুমকির মুখে পড়েনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প উদার নীতিমালাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারেন। তথাপি আমেরিকার ভারসাম্য ব্যবস্থাটি এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। ট্রাম্প থাক বা না থাক এগুলো থাকবে। প্রকৃত হুমকিটা হলো অপেক্ষাকৃত কম পরিণত বা অপরিণত গণতন্ত্রের বেলায়, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং গণতান্ত্রিক অভ্যাসগুলো জনগণের মধ্যে তেমন গ্রথিত নয়। তার পরও পাশ্চাত্যে যা ঘটে, তা এসব দেশকেও প্রভাবিত করে। আমেরিকা এক সময় পদানত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজ সেই আমেরিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন এক ব্যক্তি বসে আছেন, যিনি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি তো পরের কথা, বরং বিরাগেরই শুধু জন্ম দিতে পারেন। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রতি জনসমর্থন এখনও যথেষ্ট বেশি। পিউর জরিপে ৩৮টি দেশে দেখা গেছে যে, ৭৮ শতাংশ লোক মনে করে যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন প্রণীত হয় এমন ব্যবস্থা উত্তম। কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন আছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। এসব দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ মনে করে যে সামরিক শাসনই বরং ভাল। ২৬ শতাংশ মানুষ এমন ‘লৌহমানবের’ ধারণাটির সমর্থক, যিনি পার্লামেন্ট বা আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে স্বৈরাচার অধিকতর জনপ্রিয়। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গণতন্ত্র সমর্থন করায় নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারেন না যে, গণতন্ত্র বিলোপ করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। অবশ্য নেতাদের অনেকে গণতন্ত্রের বাহ্যিক চেহারাটা অক্ষুণœ রেখে এর মর্মবস্তুকে নস্যাত করতে উত্তরোত্তর অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। দেশে দেশে এ ব্যাপারে পার্থক্য থাকলেও নব্য স্বৈরাচারীদের নিজেদের মধ্যে কতখানি অভিন্নতা আছে এবং একে অপরের কাছ থেকে তারা কতটা মনোযোগ সহকারে শেখে, সে বিষয়টি লক্ষণীয়। খুব সহজভাবে বলতে গেলে গণতন্ত্রের পতন এভাবে ঘটে। প্রথমে দেশে একটা সঙ্কট দেখা দেয় এবং ভোটাররা তখন এমন এক জনমোহিনী নেতার পেছনে সমর্থন যোগায়, যিনি তাদের সঙ্কট থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। দ্বিতীয়ত, এই নেতা তখন শত্রু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং এর জন্য বিরামহীনভাবে জুজুর ভয় দেখানো হয়, যার সবটাই কাল্পনিক। তৃতীয়ত, তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি অসৎ পন্থায় তার তাঁবেদার বানিয়ে ফেলেন। সবশেষে তিনি দেশের প্রচলিত বিধিনিয়ম এমনভাবে পাল্টে ফেলেন, যাতে করে তাকে ক্ষমতা থেকে হটানো ভোটারদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। প্রথম তিন পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেও তার দেশটিকে গণতান্ত্রিক বলা চলে। কিন্তু শেষ পর্যায়ের কোন এক স্তরে গণতন্ত্র আর থাকে না। এ ব্যাপারে প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো হাঙ্গেরী। প্রথমে এলো আর্থিক সঙ্কট। সেই সঙ্কটের পটভূমিতে এলো ২০১০ সালের নির্বাচন। ফিদেজ পার্টি সঙ্কটের জন্য আগের সরকারকে দায়ী করে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়লাভ করল। এরপর এলো ২০১৫-১৬ সালের উদ্বাস্তু সঙ্কট। হাজার হাজার সিরীয় অভিবাসী হাঙ্গেরী হয়ে জার্মানিতে গেল। ফিদেজ পার্টির নেতা ওবরান দেশবাসীকে দেখানোর মতো দুটো শত্রু পেল। একদিকে মুসলিম উদ্বাস্তু এবং অন্যদিকে উদারপন্থী এলিট শ্রেণী, যারা উদ্বাস্তুদের আসতে দেয়ার পক্ষে ছিল। ওবরান সরকার নানা অপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে দেখাতে চাইল যে, এ সব কিছুই হচ্ছে হাঙ্গেরীয় আমেরিকান ধনকুবের জর্জ সরোসের পরিকল্পনায় বাস্তবে যার অস্তিত্ব ছিল না। ওবরান এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন যার ফলে উদ্বাস্তুর ঢল বহুলাংশে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও তিনি এই হুমকিকে কাজে লাগিয়ে চলেন এবং জনমনে সৃষ্ট ভীতির সুযোগ নিয়ে গত ৮ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। তাতে তার দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট লাভের পর শুরু হয় তাঁর গণতন্ত্রের লেবাস ঝেড়ে ফেলে স্বৈরাচারী পথে অগ্রসর হওয়ার পালা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বৈরাচারীদের দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের তাঁবেদার পরিণত করার প্রয়োজন হয়। এই কাজটা তারা হুট করে নয় বরং ক্রমান্বয়ে ও ধীরে ধীরে করে। এক্ষেত্রে প্রথম টার্গেট স্বভাবতই হয় বিচার ব্যবস্থা। গত ডিসেম্বরে পোল্যান্ডে এক আইন পাস হয়, যার বলে শাসক দল দুই-পঞ্চমাংশ বিচারককে জোর করে অবসরে পাঠিয়েছে। দেশটি এখন একটু একটু করে স্বৈরতন্ত্রের পথে পা বাড়াচ্ছে। মোটামুটি একই ঘটনা ঘটেছে ফিলিপিন্সে। অপরাধী বিশেষত মাদক কারবারীদের নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রদ্রিগো দুতার্তে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। তারপর তার মিশনে নেমে পড়েন। মাদকসেবী ও কারবারী সন্দেহে প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূত পন্থায় হত্যা করা হয়। প্রধান বিচারপতি এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরোধিতা করায় তাকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়া হয়। প্রচুর লোক হত্যার পরও ফিলিপিন্সকে মাদকমুক্ত করা যায়নি। তথাপি দুতার্তের জনসমর্থন বেড়ে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এটা আবার প্রকারান্তরে তার স্বৈরাচারী পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। মিডিয়াকেও অপকৌশলে বশে আনতে হবে। স্বৈরাচারী হওয়ার জন্য যে মানুষটি দিন গুনছেন তিনি সরকারী প্রচার মাধ্যমের দায়িত্ব নেন। সমালোচনাকারী প্রচার আউটলেটগুলোকে মিথ্যাচার ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেন। এক প্রজন্ম আগে স্বৈরাচারীরা স্বাধীন মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করে দিত। এখনকার স্বৈরাচারীরা তা না করে এমন সব সাজানো ও বানোয়াট জরিমানা ও করের বোঝা মিডিয়া মালিকদের ওপর চাপিয়ে দেন যে, শেষ পর্যন্ত তারা তাদের প্রতিষ্ঠান সরকার অনুগত টাইকুনদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এই কৌশলটির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন রাশিয়ার পুতিন। এখন তা ব্যাপক পরিসরে অনুসরণ করা হচ্ছে। তুরস্কে শেষ বড় স্বাধীন মিডিয়া গ্রুপটি গত মার্চ মাসে এরদোগানের এক বন্ধুর কাছে বিক্রি করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীকে পাশে পাওয়াটাও একজন হবু স্বৈরাচারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জিম্বাবুইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে ধরেই নিতেন যে সশস্ত্র বাহিনী তার প্রতি চির অনুগত থাকবে। সশস্ত্র বাহিনীকে খুশি রাখার জন্য ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো তাদের জাতীয় খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাতাহ আল সিসি নাগরিকদের লুণ্ঠন করা বেতনের অঙ্ক বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীকে। বিচার বিভাগ, সংবাদপত্র ও সশস্ত্র বাহিনীকে পকেটস্থ করায় লৌহমানব বা একশাসক এখন গণ্য করার মতো বাকি আর সব প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে উদ্যত হতে পারেন। পার্লামেন্টকে তিনি আড়ালে ঠেলে দিতে পারেন, নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণ করতে পারেন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারেন। স্বৈরাচারীদের মধ্যে যারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চান তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মদের বিশেষ মতে দীক্ষিত করার প্রয়োজন হয়। সে জন্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এই সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তুরস্কের এক উদারপন্থী ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, বেশিরভাগ দেশে স্কুলের পাঠ্যবইতে দুই বছর আগের ঘটনা স্থান পায় না, কিন্তু আমরা তা করি। স্বৈরাচারের উত্থান অংশত বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশের মতো বড় ধরনের ঐতিহাসিক ধারার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটে থাকে। তবে ক্ষমতালিপ্সু নেতারা এগুলোকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা শিখেছেন বলেও এমনটা হয়। স্বৈরাচারী ছাড়া স্বৈরাচার হতে পারে না। ক্ষমতার প্রতি লিপ্সা অনেকেরই থাকে। কেউ ক্ষমতা চান বিশ্বকে বদলে দেয়ার জন্য, কেউবা চান নিজেকে বদলানোর জন্য। কেউ ক্ষমতা চান শুধু এ জন্য যে ক্ষমতা অর্থবিত্ত, স্তাবকতা ও সেক্স সবই নিয়ে আসে। তাই তারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বৈরাচার আর ঘুষ-দুর্নীতি এক বিষচক্র রচনা করে। ক্ষমতার পথে যেখানে বাধা সামান্য সেখানে ক্ষমতা প্রয়োগকারীরা বা তাদের বন্ধুরা বিপুল অর্থবিত্তের অধিকারী হয়। ক্ষমতাই এটা সম্ভব করে তোলে। তারা যত চুরি করে ততই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার সর্বনাশ করতে অনুপ্রাণিত হয়। কারণ তারা জানে, একবার ক্ষমতা হারালে তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, হতে হবে বিচারের সম্মুখীন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×