ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভল্টের সোনা পরীক্ষা হবে আণবিক শক্তি কমিশনে

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ জুলাই ২০১৮

ভল্টের সোনা পরীক্ষা হবে আণবিক শক্তি কমিশনে

রহিম শেখ ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত সোনার মান যাচাই করতে অবশেষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে। আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের সমন্বয়ে সোনা পরীক্ষা করার কথা রয়েছে। এর আগে স্বর্ণকার এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মেশিনের মাধ্যমে কয়েকদফা পরীক্ষা করা হলে সোনার হিসেবে গরমিল দেখা দেয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে সোনা যাচাই করার বিষয়টি সামনে আসে। এদিকে ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি যেন মানুষের আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বিষয়টির দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্যকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত স্বর্ণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে দেশে ফেরার পর খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত একটি সোনার চাকতি এবং একটি কালো প্রলেপযুক্ত সোনার রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব স্বর্ণকার দিয়ে ওই চাকতি এবং আংটি যথাযথ ব্যক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র দেয়। তবে দুই বছর পর পরিদর্শন দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২ ক্যারেট) সোনা পায়। আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট)। এরপর শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ভাড়া করা মেশিন নিয়ে সোনা পরীক্ষা করেন। কিন্তু সংস্থাটির নিজস্ব মেশিন না থাকায় পরীক্ষার ফলাফল আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আণবিক শক্তি কমিশনে সব সোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবার বেকে বসেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা তাতে সম্মতি দেননি। দীর্ঘদিন বিষয়টি ঝুলে থাকার পর এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দেয় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। এরপর প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্র্ডের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের কাছে পাঠান। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনের প্রতিটি অংশের ব্যাখ্যা দিয়ে চলতি মাসের ১১ তারিখে এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবরে চিঠি পাঠায়। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুরক্ষা ও কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সোনার মান ও ক্যারেট কমে যাওয়া নিয়ে যে অভিযোগ এসেছে সে বিষয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত সোনার মান যাচাই করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে বারবার সোনার মান যাচাই করার কথা জানিয়েছে। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাতে সাড়া দেননি। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের সমন্বয়ে আণবিক শক্তি কমিশনে নিয়ে সোনা পরীক্ষা করা হবে। এটি করা হলে সোনার মান ও ক্যারেট কমে যাওয়া নিয়ে যে অভিযোগ এসেছে তার সুষ্ঠু সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। এদিকে ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি যেন মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বিষয়টির দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্যকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়ে এ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনার হিসাব ও ওজনে গরমিল নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে গত তিনদিন ধরে গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশ করায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিষয়টির দ্রুত সমাধানে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির ও রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে গণভবনে ডেকে পাঠান। রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান দেশে না থাকায় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (আন্তর্জাতিক চুক্তি) কালিপদ হালদার বৈঠকে অংশ নেন। বেলা ১১টার দিকে এ বৈঠক শুরু হয়ে ঘণ্টাব্যাপী চলে। সূত্র আরও জানান, বৈঠকে উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় অতি দ্রুত যাতে এ সমস্যার সমাধান হয় সে বিষয়ে উভয়পক্ষকেই নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন অর্থমন্ত্রী ॥ এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত স্বর্ণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে দেশে ফেরার পর খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বুধবার নিউইয়র্কে একটি হোটেল লবিতে এক বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলকে তিনি এ কথা বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বর্ণ নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনভাবেই ছোট করে দেখার বিষয় নয়। যাদের কাছে স্বর্ণ রাখা হলো তাদেরই বেশি দায়িত্ব। ভল্টে স্বর্ণ ঢোকানোর আগে তা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মুহিত বলে, আমি দেশে ফিরে বিষয়টি পর্যালোচনা করব এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। সত্যি যদি কোন অনিয়ম হয়ে থাকে, আর তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ যদি জড়িত থেকে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে বলে আমি মনে করি। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এফেক্টিভ ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপে যোগ দিতে ঢাকা ত্যাগ করেন। আগামী ২২ জুলাই তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এদিকে ঘটনার পর অর্থমন্ত্রীর অবর্তমানে গত বুধবার এ বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনা নিয়ে অনিয়মের খবর যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরোপুরি সত্য নয় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতিতেই এই সঙ্কট। তবে আমরা বিষয়টিকে ছোট করে দেখছি না। পর্যালোচনা করে কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×