ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মতোই গ্রামে গ্রামে ভোটের হাওয়া

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ১৬ জুলাই ২০১৮

  বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মতোই গ্রামে গ্রামে ভোটের হাওয়া

সমুদ্র হক ॥ গ্রামের পথে এই সময়টায় বর্ষার আকাশে মাঝে মধ্যে ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিতে পারেনি মানুষের মনের নীল আকাশ। গৃহস্থ ও কিষাণ বাড়ির আধাপাকা ঘরের টিনের চালায় বৃষ্টির রিমঝিম শব্দও চাপা দিতে পারেনি নিকটের নির্বাচনী শোরগোল। কোন অচেনা শহুরে ব্যক্তিকে গ্রামে দেখলেই মাঠে কর্মরত কৃষকরা তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করে কে এই লোক! পরে একে অপরকে প্রশ্ন করে ‘ক্য রে ওই মানুষ ক্যাডা! চিনিস।’ প্রতি উত্তর আসে এভাবে ‘বুঝলু না, ইলেকশন আসিচ্চে। এখন কত মানুষ আসবি আর যাবি।’ তারপর তাদের ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। ইলেকশন মানেই কিছুটা সময় আনন্দে থাকা। বিশেষ করে নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের ভিন্ন ধরনের আমেজ নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাদ্য বাজার সুর। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করা হবে। এরপর মাঠে নামবে রাজনৈতিক দলগুলো। তারপর প্রচার কার্যক্রম। সবশেষে নির্বাচন। আশা করা হয়েছে এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতেই শীতের সময়টায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ঢাকের বাদ্যে নেচে উঠবে দেশের মানুষ। এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন হয়। তার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম নির্বাচন। দুই বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের জোট ক্ষমতায় আসে। নবম নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। দশম নির্বাচনে বিএনপি বর্জন করে। পরিবর্তিত সব পরিস্থিতি এবং দেশ এগিয়ে চলার সার্বিক উন্নতিতে বিএনপির হয়ত বোধোদয় হয়েছে, তারা যদি এবারও নির্বাচন বর্জন করে তাহলে বিএনপির সমর্থকদের সঙ্গে দেশের মানুষের কাছে কঠিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। অদৃশ্যে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মুখে এই কথাটিই উচ্চারিত হচ্ছে। তবে বিএনপি সমর্থক গ্রামের মানুষ আশা করে আছে তাদের নেতারা নির্বাচনে নেবে। এদিকে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরাও যে নিশ্চিন্ত হয়ে আছে তাও নয়। মাঠ পর্যায়ে খোঁজখবর করে এবং একাধিক সূত্রে যোগাযোগ করে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সংসদ সদস্যসহ সকল নেতার আপডেটসহ গত ক’বছরের কাজের রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। একাদশ নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনে এই ‘আমলনামা’ টু দ্য পয়েন্টে বিশ্লেষণ করা হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কোন এলাকার সংসদ সদস্য এলাকার উন্নয়নের ধারায় সাধারণের কাছে কতটা জনপ্রিয় হতে পেরেছেন আগামী নির্বাচনে তাও ছবির মতো স্বচ্ছ হয়ে আসবে। তাদের জনপ্রিয়তার ফলই পাওয়া যাবে আগামী নির্বাচনে। তবে সার্বিক দিকে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রতিটি সেক্টরে। বিশেষ করে গ্রামের পথে পা বাড়ালে এখন আর নিকট অতীতের দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদ্যুত ও সোলার প্যানেলে রাতও সেখানে রোসনাই হয়ে উঠেছে। আলোকের এই রশ্নি গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর। গ্রামে একদার খড়ের চালায় বেড়া দেয়া কুঁড়েঘর নেই। গোয়ালঘরও উঠেছে। হালের গরুর পরিবর্তে প্রবেশ করেছে পাওয়ার টিলার। কৃষির যাবতীয় কাজ হয় যন্ত্রে। মৃদু রোদের গোধূলীর গ্রাম এখন অনেক সমৃদ্ধ। যেমন উর্বর জমি তেমনই মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে ধানসহ সব ধরনের ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চল এখন বহুমুখী ফসলের অপার ভান্ডার। উত্তরাঞ্চলের সবজি দিয়ে দেশ চলে, উড়াল পথে বিদেশেও যায়। স্যাটেলাইট যোগাযোগের আশাতীত প্রসারে চলতি প্রসঙ্গগুলো শহরের মানুষের চেয়ে ঢের বেশি অবগত থাকে গ্রামের মানুষ। এই সময়ে রাজনীতির কথামালা শুনলে টিভির টকশো ওয়ালাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে লজ্জা পাবে। গ্রামের মানুষ সাদা চোখে যা দেখে নিজেদের উপলব্ধিতে অনেক কিছু বুঝতে পারে অথচ নগরীর ডাক সাইটের রাজনীতিক ও সুধীজন তা অনুভব করতে পারেন না। কখনও বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে স্বপ্নে বিভোর থাকেন। গ্রামের মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ও শুনে সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন তারা চেয়ে আছে ‘ভোটের’ দিকে। কবে ইলেকশন হবে এমন প্রশ্নই তাদের। তবে বর্তমানের ভোটাররা খুবই সচেতন এবং সূক্ষè কৌশলী। আন্তরিকতার সঙ্গে অনেক কথাই কইবে। শুনতেও চাইবে নানা কিছু। তাদের স্মৃতির ঘরে ধরে রাখা নানা ঘটনার দৃশ্যপট বর্ণনা করবে। অতিথি অনাহুত অতিথির কথা, দীর্ঘ বক্তৃতা শুনবে। কোন প্রতিক্রয়া দেবে না। গ্রামের সরল সাদাসিধে মানুষ কতটা কৌশলী হয়েছে তার প্রমাণ মেলে এ ভাবেই। নির্বাচনী অতিথি পাখিরাও পাখনা মেলেছেন মাঠে প্রান্তরে। বিরোধী দলেরও অনেক চেনা অচেনা মুখ দেখা যায়। অরুণিমার হালকা গোলাপি আভায় কৃষক যখন উঠানে এসে মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তখনই অচেনা কণ্ঠের (কখনও অনেক দিনের চেনা কণ্ঠে) ডাক শোনে- কিরে কলিম উদ্দিন কেমন আছিস, বিয়ে থা করেছিস, ক’ ছেলে মেয়ে তারা কে কি করে... , তোর বাবা মা কি বেঁচে আছে! জ্যাঠার খবর কি (খোঁজ নেয়ার কৌশলটাও কম নয়। বেঁচে থাকলে তো ভোট আছে)।’ প্রার্থীর যত কৌশলই থাক ভোটারদের অদৃশ্য কূটনীতি তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। প্রথমে বোকার মতো কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকবে। তারপর একটু নড়েচড়ে এমন ভাব দেখাবে যেন ইলেকশন বার্ডের পদার্পণে তারা ধন্য হয়েছে। তারপর জি জি হ্যাঁ হ্যাঁ পর্যন্তই। মনের ভাবটি মনেই ধরে রাখবে। প্রকাশ করবে না। এদিকে সরকারী দলের অনেকেই মাঠে থাকার জানান দিয়েছেন। মাঠ প্রদক্ষিণ ও পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের আয়োজনে বিরোধী দলের স্থানীয় নেতাদের একটি অংশ ফুসছে। আন্দোলনের মাঠেও আছে, আবার চারদিকে খোঁজখবর নেয়ার পালাতেও আছে। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী বাদ্যের তালে মাঠে নামতেই হয় তাহলে মানুষের কাছে যাওয়ার কতটা সময় মিলবে, এই ভাবনাও আছে। মাঠের চিত্র দেখে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে, বর্তমানের ভোটাররা একবিংশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে দ্বিতীয় দশকের প্রায় শেষ পর্যায়ের। তারা ৯০ দশকের নয়। এতদিনে পদ্মা মেঘনা যমুনার স্রোতধারা অনেক গড়িয়েছে। মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান উন্নয়নও কম নয়। জেলা শহর থেকে উপজেলা হয়ে গ্রামের পথে বেশিরভাই পাকা রাস্তা। মেঠো পথ যে নেই তা নয়। তবে তা গ্রামের একেবারে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। বিদ্যুতও গিয়েছে অনেক গ্রামে। নদী তীরের গ্রামে খেয়াঘাট ও মাচাং চোখে পড়ে কম। পারাপারে সেতু হয়েছে। এমন ভাবেই পাল্টে যাচ্ছে গ্রাম। শহরের অনেক শিক্ষিত তরুণী গ্রামের সরকারী প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে শিশুদের শিক্ষিত করার ব্রত নিয়েছেন। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষও সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। পৃথিবী এখন তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে (আইসিটি) দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, বাংলাদেশও সুপার হাইওয়েতে দৌড়াচ্ছে। নির্বাচনে নয়ছয় করার দিন ফুড়িয়েছে। কেউ ইচ্ছা করলে কালির একটা আঁচড়ও দিতে পারবে না। দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রযুক্তিকে কতটা চিনেছে তা স্মার্ট ফোন (সেল ফোন) ব্যবহারকারীর হার দেখে সহজে বুঝে নেয়া যায়। এখন একজন দিনমজুরের কাছেও মোবাইল ফোন আছে। মানুষ যখন স্যাটেলাইটের আওতায় নিজেদের তৈরি করছে তখন বিএনপি ‘ইলেকশন’ নিয়ে অযথা বিতর্কের সৃষ্টি করছে, এমন মন্তব্য সুধীজনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বললেন, একবিংশ শতকে কোন রাজনীতিক যদি এ ধরনের কথা বলে তাহলে বিস্মিত হতে হয়। এই রাজনীতিকরা যদি জট পাকাতেই থাকেন তাহলে ভুল করবেন। সময় থাকতেই মানুষকে কাছে টেনে নিন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। টাইম এ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান (সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না)।
×