ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ উচিতপুর হাওড়

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১৪ জুলাই ২০১৮

পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ উচিতপুর হাওড়

চারপাশে হাওড়ের অথৈ জলরাশি। জলের ওপর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। আর তার মাঝখানে বালই নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য পাকা সেতু। লাল-সাদা রঙে আঁকা সেতুটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বিশালাকারে একটি সামুদ্রিক জাহাজ। আর বালই সেতুর একটু আগে রয়েছে বিশাল নৌকা ঘাট। অথৈ জলরাশি ভেদ করে হরদম সেখানে যাতায়াত করছে শত শত ইঞ্জিন নৌকা (ট্রলার)। হাওড়ের গহীনে বড় বড় জাল ফেলে মাছ ধরছেন মাঝিদের দল। চলতি বর্ষায় নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর হাওড়ে গেলেই চোখে পড়বে এমন সব নয়নাভিরাম দৃশ্য। তাই উচিতপুর এখন একটি দর্শনীয় স্থান। হাওড়-বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন সেখানে ছুটে আসছেন দূর-দূরান্তের অগণিত মানুষ। নেত্রকোনা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মদন উপজেলা সদর। আর মদন সদর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার পূর্ব দিকে এগোলেই উচিতপুরের হাওড়। নেত্রকোনা থেকে উচিতপুরে যাওয়ার রাস্তাও বেশ ভাল। এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টার পিচঢালা পথ। ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, অটোরিক্সাÑ যে কোন যানবাহনেই সহজে পৌঁছা যায় উচিতপুরে। আর পৌঁছার পর প্রথমেই চোখে পড়বে বিশাল নৌকাঘাট। স্থানীয়ভাবে ঘাট বলা হলেও আসলে এটি একটি নৌ-বন্দর। বন্দরজুড়ে শত শত ইঞ্জিন নৌকা আর হাজারও যাত্রীর ভিড়। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হরদম সেখানে নৌকা আসছে আর গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে। উচিতপুর থেকে মদন, খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে এসব জলযান। উচিতপুর ঘাটে দাঁড়িয়ে উত্তর, পূর্ব বা দক্ষিণের যে কোন দিকে তাকালেই চোখে পড়বে সমুদ্রাকৃতির বিশাল হাওড়। চোখের দৃষ্টিসীমায় হাওড়ের সীমানা শেষ হবে না। আপাতদৃষ্টিতে অমিল মনে হবে না হাওড় আর সমুদ্রের আকার-আকৃতির মধ্যেও। দূরে ঘন-কালো মেঘের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলোকে মনে হবে একেকটা দ্বীপ। আর এর মধ্য দিয়ে ধারণা পাওয়া যাবে বর্ষায় প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম সম্পর্কেও। লিলুয়া বাতাসের দিকে একটু কান পাতলে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের গর্জন ও শোনা যাবে হামেশাই। পাকা ঘাটের দু’পাশে দাঁড়ালে স্বচ্ছ জলে ভিজে যাবে দুই পা। মন-প্রাণ তখন নেচে উঠবে অপার আনন্দে। মন চাইলে উচিতপুর থেকে ভাড়ায় চালিত ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে হাওড়ের মাঝখানেও যাওয়া যায়। কূলহীন হাওড়ের মাঝখানে গেলে দেখা যায় মাঝিদের মাছ ধরার দৃশ্য। ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুলতে থাকে মাঝিদের ছোট ছোট নৌকা। উচিতপুর বন্দর থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত বালই সেতু। মদন-খালিয়াজুরি সাবমার্জিবল সড়কের মাঝখানে বালই নদীর ওপর এ সেতুটি নির্মিত হয়েছে সম্প্রতি। শুকনো মৌসুমে এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করে। আর বর্ষা মৌসুমে সড়কটি ডুবে যায়। কিন্তু সেতুটি জেগে থাকে। চারপাশে অথৈ জলের ভিতর জেগে থাকা দৃষ্টিনন্দন পাকা সেতুটিকে তখন মনে হয় নোঙর করা কোন জাহাজ। আর সেতুর দু’পাশের এ্যাপ্রোচ সড়কগুলোকে মনে হয় সী-বিচ। অনেকের মতে, সমুদ্র- সৈকত বা আশুলিয়ার জলাভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়ে কোন অংশে কম নয় উচিতপুরের দৃশ্য। উচিতপুর থেকে ট্রলারে মাত্র ১০মিনিটেই পৌঁছা যায় বালই সেতুতে। ট্রলারেরও কোন অভাব নেই সেখানে। তাই বর্ষা শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই শত শত ভ্রমণপিপাসুর ভিড় জমছে উচিতপুর এবং এর সংলগ্ন বালই সেতুতে। বলে রাখা ভাল, উচিতপুরের এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য কেবল বর্ষাতেই অবলোকন করা যায়। বর্ষার পর শুকনো মৌসুমে হাওড়জুড়ে চলে চাষাবাদ। তখন আর অথৈ জলের দেখা মিলে না। চলে না নৌকাও। বর্ষায় ভরা পূর্ণিমার রাতে উচিতপুরে গেলে ফিরে আসতে মন চাইবে না কারও। তবে রাত যাপনের কোন সুবিধা নেই উচিতপুরে। উচিতপুরের পাঁচ কিলোমিটার আগে মদন সদরে একটি ডাকবাংলো এবং একটি আবাসিক হোটেল আছে। তবে সেগুলো ততটা মানসম্মত নয়। একটু ভালভাবে থাকতে চাইলে নেত্রকোনা সদরে থাকাই ভাল। এদিকে ভাত-তারকারি বা জলখাবারের কোনো অসুবিধা নেই। সে রকম বেশকিছু দোকানপাট গড়ে উঠেছে উচিতপুরে। ভ্রমণপিপাসু এবং স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, উচিতপুর এলাকাটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সামান্য কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে দূর-দূরান্তের ভ্রমণপিপাসুদের রাত-যাপনের জন্য উচিতপুরে একটি আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। আর দরকার উচিতপুর ঘাট থেকে বালই সেতু পর্যন্ত বিরামহীন দুটি ট্রলারের ব্যবস্থা করা। এতে করে ভ্রমণপিপাসুরা কম খরচে যাতায়াত করতে পারবেন। এছাড়া বর্ষাকালে উচিতপুর ঘাটে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে। এতে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন এ সামান্য ক’টা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেই ‘উচিতপুর’ হয়ে উঠবে দেশের নতুন একটি পর্যটন কেন্দ্র। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×