ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

২৬ জুলাই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক

মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সঙ্কট চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৩ জুলাই ২০১৮

মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সঙ্কট চ্যালেঞ্জ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক টাকার চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা কালো টাকার প্রবাহ বেশি হবে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এতেও মূল্যস্ফীতি চাপে পড়বে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট রয়েছে। ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কটও প্রকট। এ রকম নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রধান লক্ষ্য। সূত্র বলছে, চলতি মাসের ২৬ জুলাই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির ওপর জোর দেয়া এবারও মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্যই থাকছে। তবে এবার যেহেতু বাজেটে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সরকারী খাতের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে, সেহেতু বেসরকারী খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লাগাম টানতেই হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তবে নির্বাচনের বছরে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার যেখানে ঋণের সুদহার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনাটা সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলেও মনে করছেন তারা। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে আসবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে মূল বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে (মূলত সঞ্চয়পত্র থেকে) বেশি ঋণ আসায় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে লক্ষ্য অনুযায়ী ঋণ নিতে হয়নি সরকারকে। যেকারণে সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্য কমিয়ে হয় ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য কমিয়ে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রসহ জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে ২৬ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এমন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে, যখন ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক টাকার চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা কালো টাকার প্রবাহ বেশি হবে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। এতেও মূল্যস্ফীতি চাপে পড়বে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট রয়েছে। ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কটও প্রকট। এ রকম বহুমুখী সঙ্কটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে যেহেতু মুদ্রানীতি ঘোষিত হচ্ছে সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণ, তারল্য সঙ্কট নিরসন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় বেসরকারী খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮.১ শতাংশ। ওই সময় মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারী খাতের ঋণের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ১৬.৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নেয়া হয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা করে কমিয়ে আনে। সনাতনী ব্যাংকগুলোর এডিআর ৮৫ থেকে কমিয়ে ৮৩.৫ শতাংশে এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আইডিআর ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশ করা হয়। ঋণের প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মাত্রায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ওই নির্দেশনা দেয়া হলেও ব্যাংকগুলো সেটা বাস্তবায়ন করতে আমানত বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে। ফলে মুদ্রানীতি ঘোষণার পরের মাস ফেব্রুয়ারি থেকেই আমানতের সুদহার ৫-৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১-১২ শতাংশে পৌঁছে যায়। এ নিয়ে শুরু হয় নতুন সঙ্কট। ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহারও বেড়ে ১৮-১৯ শতাংশে পৌঁছে যায় অল্প সময়ের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মার্চে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ব্যাংকঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। সব শেষে গত ১ জুলাই থেকে বেশির ভাগ ব্যাংকই এক অঙ্কের সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয়। এই পরিস্থিতিতে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতির কৌশল নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও এর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন ও কৌশল নির্ধারণ নিয়ে বৈঠক করেন গবর্নর ফজলে কবির। এরপর গত বুধবার রাতে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রণয়ন নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে মুদ্রানীতি নিয়ে এবারই প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের পর্ষদ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে পরামর্শও নেয়া হবে। এ লক্ষ্যে আগামী রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিশেষ পর্ষদ সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভায় মুদ্রানীতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরা হবে। এর আগে কখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজে পর্ষদের সভা করেনি।
×