ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘মাদক খাইয়া পোলাডা মইরা গেছে, ফিরাইতে পারলাম না’

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১২ জুলাই ২০১৮

‘মাদক খাইয়া পোলাডা মইরা গেছে, ফিরাইতে পারলাম না’

শংকর কুমার দে ॥ অভিশপ্ত মাদকের ছোবলে সন্তানহারা এক বৃদ্ধ মা আবেদা বেগম। মাদকাসক্ত হয়ে মারা যাওয়া ছেলে বাদশার অকাল করুণ মৃত্যুতে ২০ বছর ধরে চোখের জল ফেলছেন তিনি। মাদকের করাল গ্রাসে সবুজবাগ থানাধীন ওহাব কলোনি কিভাবে একের পর এক জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে কালের সাক্ষী বৃদ্ধ আবেদা। ২০ বছরে এই ওহাব কলোনিতে মাদকাসক্ত হয়ে করুণ মৃত্যু ঘটেছে ৩৫ জনের। দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানেও ওহাব কলোনি মাদকের কলঙ্কমুক্ত হতে পারল না। সরেজমিন ঘুরে, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে, পুলিশের কাছে পাওয়া তথ্যে মাদকের স্পট সবুজবাগ থানাধীন ওহাব কলোনির এই চিত্র পাওয়া গেছে। মাদকাসক্ত ছেলের করুণ মৃত্যুর ঘটনার ২০ বছরের স্মৃতি হাতড়ে চোখের জলে বৃদ্ধ আবেদা বলেন, মাদক কারবারিদের ফাঁদে পড়ে হেরোইন, প্যাথেডিন ইনজেকশন, ফেনসিডিল, মদসহ সব ধরনের মাদকই সেবন করত আমার ছেলে বাদশা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছেলেকে ভাল করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না পরিবারের। চিকিৎসার খরচ যোগাতে বাড়ি বন্ধক রেখে অর্থ যোগাড় করেছি। কত যে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ছেলে আমার শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি। ভেজা চোখ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে তিনি বলেন, মাদক খাইয়া (সেবন) আমার পোলাডা মইরা গ্যাছে। শত চেষ্টা কইরাও ছেলেডারে ফিরাইতে পারলাম না। এহন নিজেরও বাঁচতে ইচ্ছা হয় না। বৃদ্ধ আবেদার ছেলে বাদশার মতো ঠিক একইভাবে ২০ বছরে এই ওহাব কলোনিতে মাদকের ছোবলে অকালে মারা গেছে এমন ৩৫ জন। এই মরণনেশা মাদকের কারণে মারা গেছে আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর, জয়নাল, বাবু, জীবন, সাদেক, আমির আলী, আনোয়ার, রইচ, নাঈম, আসলাম, লাক্কা, আছিয়ারা। এদের পরিবারের লোকজন এখন মনেপ্রাণে চাচ্ছেন দেশ যেন মাদক মুক্ত হয়। তাদের সন্তানদের মতো আর কোন মা যেন সর্বনাশা মাদক নেশায় অকালেই ঝরে না যায়। দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকার মধ্যেই রাজধানীর অন্যতম মাদক প্রবণ এলাকা মতিঝিলের সবুজবাগ থানার বাসাবোর ওহাব কলোনির এই তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু যে মাদকাসক্তের ছোবলেই এই ওহাব কলোনিতে মৃত্যুর মিছিল বেড়েছে তা নয়, অনেকে আবার মাদক কারবারের আধিপত্য বিস্তার, দ্বন্দ্ব বিরোধের কারণেন খুন হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামানো যাচ্ছে না রাজধানীর সবুজবাগের ওহাব কলোনির ভয়বহ মাদক কারবার। এলাকায় এখনও গোপনে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি হচ্ছে। আর এই মাদক বিক্রি করছে মাফিয়া চক্রের অন্যতম সদস্য, ময়না, তার স্বামী মিন্টুসহ তাদের পরিবারের আরও ছয় সদস্য রনি, ইয়াসমিন, শফিক, কামাল, লিখন, হিরামনি। অন্যরা হলো সোভা ও তার স্বামী আইয়ুব, মেয়ে তানিয়া। আলী হোসেন, খায়রুল। এদের সহযোগী মস্তমিয়া, বুলি, কামাল, লিখন, হিরামনি, হিরন, মিন্টু, আমেনা, রমজান, খাদিজা, নাসর, মোমেনা বেগম, হালিম, হাবুল্লাহ, শাহিদা, বানু, চ-াল মাসুদ, শাহীন ওরফে চিকা শাহীন, স্বপন, শামীম, শান্ত, জাহানারা, খাইরুল, ফারুক, আলেয়া বেগম, সাগর কামলা, রাসেল, আবাহানী, রাজিয়া বেগম, জশু মিয়া, নুরজাহান, সেলিনা, মাসুম, মজিবর, সালাউদ্দিন, পিয়াসা, সুমন, পারভীন, কমলী ও ছাহেরা। পুলিশের তালিকায় মাদক স্পট ওহাব কলোনিতে মাদক কারবারিদের সহযোগিতাকারী অর্থাৎ যারা এলাকায় মাদকের দালালি করে এমন অনেক সদস্য রয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি যারা মাদকের দালাল হিসেবে পরিচিত। এখানকার মাদক স্পটে কয়েকটি বাড়ি আছে যেগুলো মাদকের আখড়া। এই মাদক আখড়া ওহাব কলোনির এক সময়ের শীর্ষ মাদক কারবারি ছিল মাফিয়া চুন্নি। সে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ছিল। পরে তার লাশ উদ্ধার হয়। এক পর্যায়ে মাফিয়া চুন্নির ছেলেও খুন হয়। এলাকায় মাদক নির্মূল করতে গিয়ে এই মাদক চক্রের হাতে খুন হন স্থানীয় একজন চিকিৎসকসহ অনেকেই। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ওহাব কলোনিতেও অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু মাদক কারবারিদের মধ্যে যাদের নাম আছে তাদের একজনকেও গ্রেফতার করা যায়নি। অভিযান চালায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, স্পেশাল আর্মড ফোর্স ও ডগ স্কোয়াডের সম্মিলিত বিশেষ বাহিনী। তবে অভিযানে মাদক বিক্রি ও সেবনের দায়ে সন্দেহভাজন ৩৩ জনকে আটক করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫০০০ পিস ইয়াবা, ১০০ পুরিয়া হেরোইন, ১০কেজি গাঁজা ও ৬ বোতল ফেনসিডিল। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চলমান অভিযানের আগেই এরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। পালিয়ে গিয়ে নতুন আস্তানা গড়ে তুলেছে খিলগাঁও, মুগদা, নামাপাড়া এলাকায়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাজধানীর যে কোন এলাকা থেকে ওহাব কলোনি ও আশেপাশের এলাকার মাদক কারবারিরা অনেক ভয়ঙ্কর। এদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের নিয়মিত অর্থ লেনদেন হয়।
×