ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘এসিড সন্ত্রাসী অপুর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, ওর ফাঁসি চাই’

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৯ জুলাই ২০১৮

  ‘এসিড সন্ত্রাসী অপুর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, ওর ফাঁসি  চাই’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘মেয়েটা এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করেছিল। পড়ালেখা শিখে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে এমন অনেক আশা। আমার মেয়ে চাকরি করতে চেয়েছিল। এক সন্ত্রাসী এসিড দিয়ে তার শরীরটা জ্বালায়ে দিল। আমার মা এই কয়দিন মরণজ্বালা সহ্য করেও বেঁচে উঠল না। আমারে ছেড়ে চলে গেল।’ ডুকরে কেঁদে উঠে কথাগুলো বলছিলেন ভোলায় এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কিশোরী তানজিম আক্তার মালার মা জান্নাতুল ফেরদৌস। মেয়ের কথা শুনতেই আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘এই কয়দিন আমার মেয়ের শ্বাস ছিল। ভাবতাম এই বুঝি সে সুস্থ হয়ে উঠবে। আর সে আমার বুকে ফিরবে না।’ তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে মেয়ের গায়ে এসিড নিক্ষেপের অপরাধে অপরাধী অপুর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘অপুর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। ওর ফাঁসি চাই। যদি ভোলাতে ওর ফাঁসি হয়, তাইলে এসিড নিক্ষেপ অনেক কমে যাবে।’ ১৪ মে নিজ ঘরে ছোট বোনের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল সদ্য এসএসসি পাস কিশোরী তানজিম আক্তার মালা (১৬)। ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দীঘলদী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রাম রাত বাড়লে নীরব, সুনসান। সেই রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙ্গে যায় তানজিম আক্তার মালা ও তার বোন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু মারজিয়ার (৮) আর্ত চিৎকারে। বাবা হেলাল রাঢ়ী, মা জান্নাতুলসহ আশেপাশের মানুষ ছুটে এসে দেখতে পান কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে তানজিম ও মারজিয়া। পরিবারের সদস্যরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি কী হয়েছে ওদের। কিন্তু, ‘জ্বলে যাচ্ছে’ আর ‘কে দিলো’, ‘কে মারল’ বলে চিৎকার করছিল যখন তানজিম। আর তখনই তারা বুঝতে পারেন তাদের দুই মেয়ে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এসিডে মালার শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক চোখ, এক কান ও নাকের খানিকটা গলে যায়। আরেক চোখের অবস্থাও ভাল ছিল না। তাছাড়া মুখ থেকে বুকের নিচ পর্যন্ত গভীরভাবে দগ্ধ হয়। চিকিৎসকেরা জানান, শ্বাসনালীসহ তার শরীরের ২৪ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। ভোলা থেকে প্রথমে তাকে মিরপুরে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়। পরে সিটি হাসপাতালে নেয়া হয়। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো মালাকে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তার মৃত্যু হয় বলে জানান চিকিৎিসক শহিদুল বারী। অন্যদিকে, মারজিয়া এখন খানিকটা সুস্থের দিকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মারজিয়ার কাঁধ ও গলা এসিডে ঝলসে গেলেও এখন সে ঝুঁকিমুক্ত। হয়তো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। সে এখন রাজধানীর এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি। মেয়েদের ধরতে গিয়ে এসিডে পুড়ে গেছে মায়ের হাতও। ছোট মেয়ে মারজিয়া আর তিনি এখানেই চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক মারজিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘ওর কাঁধে ও গলায় বার্ন আছে। ও এখন ঝুঁকিমুক্ত। ওর মেয়েকে ধরতে গিয়ে মায়ের বাম হাত পুড়ে গেছে। তিনিও এখন আন্ডার ট্রিটমেন্টে আছেন। তবে, তিনিও ঝুঁকিমুক্ত।’ তানজিম ও মারজিয়ার বাবা মো. হেলাল রাঢ়ী চট্টগ্রামে রংমিস্ত্রির কাজ করেন। দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী ভোলায় থাকেন। তানজিম ভোলা থেকে এসএসসি পাস করে। দুই মাস আগে মুঠোফোনে রং নম্বরের মাধ্যমে মহব্বত হাওলাদার (১৯) নামের একজনের সঙ্গে তানজিমের পরিচয় হয়। তিনি তানজিমের ভাল-মন্দের খোঁজ নিতেন। তানজিম কোন কলেজে ভর্তি হবে, তা নিয়ে ওদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগে। তানজিমের সঙ্গে অন্য কোন ছেলের প্রেমের সম্পর্ক আছে, মূলত এ সন্দেহের কারণেই মহব্বত এসিড মারে। সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেফতারের পর ২৬ মে মহব্বত হাওলাদার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে এসিড মারার কথা স্বীকার করেছে। এখন সে কারাগারে আছে। জিজ্ঞাসা করলে থেমে থেমে সে ভয়াবহ রাতের কথা বলেন মালার মা জান্নাতুল ফেরদৌস, ‘আমার মেয়ের গায়ে যখন এসিড লাগছে তখন সে কে দিলো কে দিলো বলে চিৎকার মারছে। আমি আজ পর্যন্ত এসব (এসিড ছুড়ে মারার ঘটনা) দেখি নাই। এমন করে মেয়ের যে বিপদ হয় জানিই না। আমরা পুকুরে নিয়া মেয়েরে বসাই রাখছি। মেয়ের গায়ের কাপড় পুড়ে গেছে।’ যে মেয়ে এসএসসি পাস করে এইচএসসিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল হঠাৎ করে সে এমন পরিস্থিতির শিকার হলো কেন জানতে চাইলে ক্রোধে বিস্ফারিত চোখে তানজিমের মা বলেন, ‘ অপুরে যদি পাইতাম, আমি অরে নিজ হাতে শিক্ষা দিতাম। আমাদের তিন মা-ছায়ের জীবন হে শেষ কইর‌্যা দিছে।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এই এসিড সন্ত্রাসের হোতা হিসেবে অভিযুক্ত মহব্বত হাওলাদার অপুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পরদিন ১৬ মে গ্রেফতারের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ভোলার পুলিশ সুপার মোঃ মোকতার হোসেন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপু পুলিশের কাছে এসিড নিক্ষেপের কথা স্বীকার করেছে। পরে আদালতেও এ কথা স্বীকার করে সে। অপুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী প্রেমঘটিত বিবাদের কারণে তানজিমের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ‘শিক্ষা দেয়ার’ জন্য এ ঘটনা ঘটায়। এ সময় সে মালার বিরুদ্ধে একাধিক জনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত থাকার অভিযোগ করে। তবে মুমূর্ষু অবস্থায় তানজিম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সে জানিয়েছে, অন্য বন্ধু এবং নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ককে অন্য কিছু ভেবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে অপু। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সবসময় এসিড সন্ত্রাসীর শিকার ভিকটিমদেরকে সাহায্য করে থাকি। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে মালাসহ তার মা ও বোনকে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছি। মালা সারভাইভ করতে পারল না। ওর মা ও বোনের অবস্থা তেমন আশঙ্কাজনক নয়। আমরা চাই এসিড যে ছুড়েছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। তাকে যেন জামিন না দেয়া হয়।’ এমন ভয়াবহ ঘটনার পরেও ভোলায় এসিড নিক্ষেপ থামেনি। গত ১ জুলাই গভীর রাতে দাদির সঙ্গে ঘুমন্ত অবস্থায় একইভাবে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ থানার রসুলপুর ইউনিয়নের শশীভূষণ গ্রামের আয়েশা বেগম (১৪) নামে আরেক কিশোরী। দুর্বৃত্তরা এসিড নিক্ষেপ করে তারও মুখমণ্ডলসহ শরীর ঝলসে দিয়েছে। প্রতি বছরই দেশের অনেক নারীরা বিভিন্নভাবে এসিড সন্ত্রাসের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০১৭ সালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ৪০ জন। তন্মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুই জনের। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ৩৪ জন নারী ও শিশু এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় একজন মারা যান। ২০১৫ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। মহিলা পরিষদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসিড সন্ত্রাসের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে ২৯ শতাংশ প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায়, ১৮ শতাংশ শক্রতার কারণে এবং ৭ শতাংশ যৌতুক ও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি না দেয়ায় অন্তত ৭ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছে।
×