ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রধানের বক্তব্যে হতাশার সুর

মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধ্য করা সুদূরপরাহত!

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৪ জুলাই ২০১৮

মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধ্য করা সুদূরপরাহত!

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের বিষয়টি আশা-নিরাশার দোলাচলে। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে এ নিয়ে সমাধানের কার্যকর কোন ব্যবস্থা এখনও দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম সোমবার সরেজমিনে কক্সবাজার এসে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে গেছেন। এই দু’জনের বক্তব্য থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান নিয়ে নানা বক্তব্য এলে হতাশাও রয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলে গেছেন, এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। অপরদিকে, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলে গেছেন রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট গত রবিবার জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার এখন প্রস্তুত নয়। সঙ্গত কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আশার কোন আলো এখনও দেখা যাচ্ছে না। এই ইস্যুতে মিয়ানমার পক্ষ বাংলাদেশ এবং ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে ইতোমধ্যে যেসব চুক্তি করেছে এবং এর পাশাপাশি যেসব বৈঠক করেছে তাতেও প্রকৃত অর্থে আশার কোন বাণী নেই। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারের বর্তমান সরকার সে দেশের সেনাবাহিনীর চাপের মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের দফায় দফায় চাপের মুখে পড়ে সে দেশের সেনাবাহিনীর কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা স্রেফ আইওয়াশ হিসেবেই আলোচিত হচ্ছে। এদিকে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক সফলতা কম নয়। কিন্তু মূল ইস্যু এদের প্রত্যাবাসিত হওয়া। আর এই প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার এখনও তাদের অটল অবস্থানে রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মনোভাব যেমন এগুচ্ছে না, তেমনি তাদেরকে ফিরে না যাওয়ার জন্য উস্কানিমূলক তৎপরতারও কমতি নেই। সবকিছু মিলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের একটি বোঝা হয়ে চেপেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের প্রকৃত উদ্যোগ না থাকায় মিয়ানমার পক্ষ এ নিয়ে কোন তোয়াক্কাই করছে না। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত আদালতের পক্ষেও মিয়ানমার সরকারের কাছে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য ইতোমধ্যে চাওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষে এ নিয়ে কি জানান দেবে তা তাদের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, গেল বছরের ২৫ আগস্টের রাতের পর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে যে বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে তার ভিডিও চিত্র সারাবিশ্ব জেনেছে, যা কোনভাবেই ধামাচাপা দেয়ার অবকাশ নেই। এরপরও মিয়ানমার পক্ষ এই ইস্যুটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যে কারণে বিভিন্ন বৈঠকে মিয়ানমার পক্ষ কথা দিয়েও তা থেকে দূরে সরে রয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। ট্রানজিট ক্যাম্পও প্রস্তুত রয়েছে। দু’দফায় মিয়ানমার পক্ষ বাংলাদেশ থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তালিকাও নিয়েছে। এসবের পরেও তারা সেখান থেকে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বলে জানান দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এ প্রক্রিয়া আর কতদিন। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের দশ মাস পেরিয়ে গেছে। আর শরণার্থী হিসেবে বছরের পর বছর রয়ে গেছে ৩২ হাজারেরও বেশি। গত বছর আগস্টের পর থেকে যারা এসেছে তাদেরকে আশ্রিত হিসেবেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আর এর আগে যারা এসেছিল তাদেকে বলা হয় শরণার্থী। শরণার্থী আর আশ্রিত যে অভিধায় অভিষিক্ত করা হোক না কেন, মূলত এরা মিয়ানমার থেকে বিশেষ করে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা এবং সে দেশের নাগরিক। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর এখন মিয়ানমার পক্ষ বলছে-তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ ছাড়া কাউকে নেয়া হবে না। একদিকে নাগরিকত্বের অধিকার হরণ, তার ওপর বিতাড়ন-দুই-ই করেছে মিয়ানমার পক্ষ। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সরকার এদেরকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য সীমান্ত অবাধ করে রেখেছে। পক্ষান্তরে কড়াকড়ি আরোপ করে রেখেছে কোন রোহিঙ্গা যেন ফিরে যেতে না পারে। এর পাশাপাশি কাঁটাতারের বেড়া সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্থল মাইন পোঁতা হয়েছে। বাঙ্কার খনন করে সেনা মোতায়েন ও বিভিন্ন পয়েন্টে সেনা সদস্যদের জন্য নতুন নতুন ব্যারাক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে মিয়ানমারের মনোভাব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অনুকূলে নয় বলেই সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের মত রয়েছে। এদিকে, এর পরও বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ক্রমাগতভাবে বাড়ানো হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সারাবিশ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় চলে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আলোচনা, দাবি, সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে এদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পথ করে দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা। সে বাধ্য করার বিষয়টি এখনও নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। ইতোপূর্বে মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করেও পিছিয়ে গেছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রত্যাবাসন না করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। যে কারণে রোহিঙ্গাদের মাঝে যারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় না তারা উচ্ছ্বসিত। আশ্রয়ের পাশাপাশি নিয়মিত ত্রাণ সামগ্রীর যোগান পেয়ে এরা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে চলতি বর্ষা মওসুমে কোন ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। যার মধ্যে প্রাণহানির বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের পর অনেকে আশার আলো তথা আলোচনায় এনেছেন সত্য। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষকে এই ইস্যু সমাধানে বাধ্য করার মতো কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি এখনও হয়নি। ফলে একদিকে আশা ও অন্যদিকে নিরাশার দোলাচল রয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের নিয়ে কক্সবাজার প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা বহু আগে থেকে হিমশিম খাচ্ছে। রোাহিঙ্গারা কোন ধরনের আইন-কানুন মানতে চায় না। এদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এখনও মিয়ানমার থেকে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। আর ওপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী ও বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) এক শ্রেণীর সদস্যরা এসব অপকর্মে জড়িত। ফলে মিয়ানমারের পক্ষে বাংলাদেশের জন্য দুভাবে বড় ধরনের ক্ষতি করে যাচ্ছে। একদিকে মাদকের চালান আসতে সহায়তা, আরেক দিকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চাপিয়ে রাখা দুটোই বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মঙ্গলবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত শারলোটা স্লাইটার বলেছেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো যথাযথভাবে তদন্তও করতে হবে। রাষ্ট্রদূত বলেন, সুইডেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে।
×