ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন ভাষা সংগ্রামী হালিমা খাতুন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৪ জুলাই ২০১৮

চলে গেলেন ভাষা সংগ্রামী হালিমা খাতুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে শঙ্কাহীন চিত্তে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি নেমেছিলেন রাজপথে। উপেক্ষা করেছিলেন মৃত্যু ভয়কে। সংগঠিত করেছিলেন ছাত্রীদের। নারী দলের অগ্রণী সদস্য হিসেবে মিছিল করে ভেঙ্গে ছিলেন ১৪৪ ধারা। নিয়তির পথরেখায় প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন সেই সাহসিকা ভাষা সংগ্রামী ও শিশুসাহিত্যিক হালিমা খাতুন। গুরুতর অসুস্থ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। রেখে গেছেন একমাত্র মেয়ে প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবনীসহ আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী। হালিমা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। হালিমা খাতুনের মেয়ে প্রজ্ঞা লাবনী জানান, মঙ্গলবার তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নাতনি অন্তরা বিনতে আরিফের ধানম-ির বাসায়। রাতে সেখানেই ফ্রিজিং ভ্যানে হালিমা খাতুনের শবদেহ রাখা হয়েছে। আজ বুধবার সকাল ১১টায় তার মরদেহ নিয়ে আসা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তার নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বাদ যোহর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে। হালিমা খাতুনের মৃত্যুর বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন এ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের প্রধান সাগুফা আানোয়ার জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটে তিনি মারা যান। হাসপাতালের প্রধান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মমিনুজ্জামানের অধীনে ভর্তি ছিলেন তিনি। হালিমা খাতুন হৃদরোগ, কিডনিসহ রক্তদূষণের মতো নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত বৃহস্পতিবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার দুপুরে ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তরের পর তাকে প্রথমে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে এই হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ফাতেমা বেগমের অধীনে তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে তার নাতনি অন্তরা বিনতে আরিফ বলেন, বৃহস্পতিবার প্রথমে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্লাডের সেপটিকসেমিয়া, আর ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হওয়ায় চিকিৎসকরা স্যালাইন আর ব্লাড দেয়া শুরু করেন। পরে শুক্রবার রাতের দিকে তার ইউরিন ক্রমাগত কমতে শুরু করে। পরদিন সকালে তার রক্তবমি হয়। স্বাস্থ্যের সিসিইউ থেকে তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হালিমা খাতুনের মৃত্যুর খবরে শোকাহত আরেক ভাষাসংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জমাতৃভাষা বাংলার প্রতি অপরিসীম ভালবাসার থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে যে ক’জন ছাত্রী রাজপথে নেমে এসেছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করার পেছনেও তার ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা এ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। হালিমা খাতুনের মৃত্যুতে এক শোক বার্তায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তিনি ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যতদিন এ জনপদে বাংলা ভাষা টিকে থাকবে, ততদিন ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুনের অবদান বাঙালী জাতি স্মরণে রাখবে। শোকবাণীতে সংষ্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতে হালিমা খাতুনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যতদিন এ জনপদে বাংলা ভাষা টিকে থাকবে, ততদিন ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুনের অবদান বাঙালী জাতি স্মরণে রাখবে। ১৯৩৩ সালের ২৫ অগাস্ট বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. হালিমা খাতুন। বাবার নাম আবদুর রহিম শেখ ও মা দৌলতুননেসা। হালিমা খাতুনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর মনমোহিনী গার্লস স্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে ইংরেজীতে এম এ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাস করেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে খুলনা করোনেশন স্কুল এবং আরকে গার্লস কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। এরপর কিছুদিন রাজশাহী গার্লস কলেজে অধ্যাপনার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট-এ। এখানেই কাটে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়। এখান থেকে ১৯৯৭ সালে অবসর নেন। এরপর জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে ২ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কলেজ জীবনেই রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশজুড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতে পারেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হবেন। ২১ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে হালিমা খাতুন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী। সব বিভাগ মিলে সর্বমোট ৪০-৫০ জন ছাত্রী ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টটি এখন রোকেয়া হল নামে পরিচিত। এই হলে মোট ৩০ জন ছাত্রী থাকত। তাদের একজন হালিমা খাতুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোকেয়া খাতুন ও সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে হালিমা খাতুন ‘হুইসপারি ক্যাম্পেইন’-এ যোগ দেন। তাদের প্রধান কাজ ছিল ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। বায়ান্নের ২১শে ফেব্রুয়ারি সবাই আমতলায় সমবেত হন। ছাত্রীদের দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীদের এই আন্দোলনে শামিল করা। মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ে হালিমা খাতুনের ওপর। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য দেয়ার পর পরই সেøাগানে সেøাগানে কেঁপে ওঠে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’- সেøাগান চারপাশে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হয় মেয়েদের দল। তার সদস্য থাকে ৪ জন। সেই দলে জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে হালিমা খাতুনও ছিলেন। একে একে বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে মেয়েদের ৩টি দল বেরিয়ে আসে। শুরু হয় লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া। সবাই ছুটছে যে যার মতো। তবে সবার লক্ষ্য জগন্নাথ হলের এ্যাসেমব্লির দিকে। হালিমা খাতুনসহ অনেক ভাষা সৈনিক আশ্রয় নেয় মেডিক্যালে। রাস্তায় শহীদের তাজা রক্ত। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সবাই ছুটছে। ছাত্ররা ওই মাথার খুলির ছবি তুলে সেই ছবিটি ছেলেদের হলে রাখে। হলের রুমের দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ রুম থেকে ছবিটি আনার দায়িত্ব পড়ে হালিমা খাতুুনের ওপর। অন্ধকার রাতে রাবেয়া ও হালিমা জীবনবাজি রেখে পুলিশের সামনে দিয়ে গিয়ে ছবিটি নিয়ে আসেন বুকের ভেতর করে। পরের দিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই ছবি ছাপানো হয়। ভাষা আন্দোলনের তার অনন্য অবদানের জন্য শিল্পকলা একাডেমি হালিমা খাতুনকে ভাষাসৈনিক সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়া শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
×