ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বল্প সুদে ৩শ’ কোটি ডলার দেয়া হবে ॥ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট

রোহিঙ্গা অধিকার রক্ষায় মিয়ানমার ব্যর্থ ॥ গুতেরেস

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৩ জুলাই ২০১৮

রোহিঙ্গা অধিকার রক্ষায় মিয়ানমার ব্যর্থ ॥ গুতেরেস

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন জাতিসংঘ নয়, রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় মিয়ানমারই ব্যর্থ। রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুবিধা মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরার এই ইস্যুতে তার পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত নয় বলে তারা মনে করছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্বরোচিত সেনা অভিযানের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত হয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতের পর থেকে সে রাজ্যে যে নারকীয় ঘটনাবলী ঘটেছে তাতে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াওয়ের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত হওয়ার পর সংখ্যার দিকে বিশ্বব্যাপী এটি সর্বোচ্চ হিসাবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ইস্যুটি সারাবিশ্বে তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু মগের মুল্লুকের দেশ হিসাবে খ্যাত মিয়ানমার এই ইস্যুর সমাধানে এখনও আন্তরিক নয়। বিশ্বের নানা দেশের প্রতিনিধিদের পক্ষে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করা হয়েছে। এ পর্যায়ে সর্বশেষ এলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। এ দুই সংস্থার শীর্ষ দুই প্রধান একসঙ্গে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ও প্রত্যাবাসন কেন্দ্র পরিদর্শন করার পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রাখাইনের রোহিঙ্গাদের নাগরিকসহ সব সুবিধা মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, জাতিসংঘ নয়, রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় মিয়ানমারই ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। এরপরও তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে জাতিসংঘ। সেভাবেই আমরা কাজ করছি। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খামখেয়ালিপনায় দ্রুত এগোনো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রিত জীবন বড়ই কষ্টকর। তারা যে পরিস্থিতির মুখে পড়ে মিয়ানমার ছেড়েছে, সভ্যতার দিকে তা কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশ চলমান সময়ের শ্রেষ্ঠ মানবিক আচরণে তাদের ঠাঁই দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বর্ষায় আশ্রিতদের নিরাপদে রাখাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার। প্রাণহানি এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত পয়েন্টগুলো থেকে ২ লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। প্রাণে বাঁচতে সহযোহিতা যখন দেয়া হয়েছে তখন বর্ষায় তাদের আসা ভাসিয়ে দেয়া উচিত হবে না। সংবাদ ব্রিফিংয়ে মতামত তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমও। তিনি দাবি করেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তুলনায় সহায়তায় প্রাপ্ত সামগ্রী অপ্রতুল। তিনি অসহায় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আরও বেশি সহায়তা প্রদানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি ঘোষণা দেন একসঙ্গে এতবেশি সংখ্যক লোককে আশ্রয় দেয়ায় শ্রেষ্ঠ মানবিক আচরণ করা বাংলাদেশ সরকারকে আগের ৪৮০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াও স্বল্প সুদে নতুন করে ৩ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। সোমবার সকালে জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছার পর তাদের নেয়া হয় সাইমন বীচ রিসোর্টে। সেখানে তাদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। এরপরে তাঁরা যান উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে। বেলা বারটার আগে তারা পৌঁছেন কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে। পরিদর্শন করেন ক্যাম্পের এক্সটেনশন-৪, নিবন্ধিত সি ব্লক ও ডি ব্লকের বিভিন্ন ক্যাম্প। পরিদর্শনকালে তারা সমবেত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মুখ থেকে রাখাইন রাজ্যে কি বর্বর ঘটনা ঘটেছে, কিভাবে রোহিঙ্গাতের হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, গুম করা হয়েছে, নারী ও যুবতীরা ধর্ষিত হয়েছে এর বিস্তারিত বর্ণনা শোনেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডি এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বিষয়ক নির্বাহী পরিচালক ড. নাতালিয়া খানেমসহ সংস্থার অধীন বিভিন্ন সংস্থার এক ডজনেরও বেশি কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে উপস্থিত রোহিঙ্গারা জানান, নাগরিক হিসাবে পূর্ণ অধিকার ছাড়া মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ হবে না। তাই মৌলিক সকল অধিকার নিয়েই তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। অন্যান্য যতই অধিকার দেয়া হোক না কেন, নাগরিকত্বের পূর্ণ অধিকার ছাড়া তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। রোহিঙ্গা নেতারা জানান দেন যে, তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান, জায়গাজমি, ভিটেবাড়ি ফিরিয়ে দিলে তারা সহসায় স্বদেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব নিজ টুইটারে শেয়ার করে লিখেছেন, আমি বাংলাদেশের কক্সবাজার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা সদস্যদের কাছ থেকে রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও বর্বরতার নানা কাহিনী শুনেছি। তারা ন্যায় বিচার ও নিরাপদে বাড়িতে ফিরতে চায়। এর আগে গত রবিবার জাতিসংঘ মহাসচিব তার অফিসিয়াল টুইটার একাউন্টে সংস্থার শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের প্রকাশিত রোহিঙ্গা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নিয়ে শেয়ার করেছেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেছেন, রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন ও বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম। মানবিকতা আর মানবিকতার প্রশ্নের বিবেচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট এক দুঃস্বপ্নের মতো। এদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদার ভূমিকায় আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময়ে দুপুরেই জাতিসংঘ মহাসচিব টুইটারে বলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকার করেনা। উগ্র বৌদ্ধদের ব্যবহার করে সেখানে সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোন নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলছে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড। কখনও আবার ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড বা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র। এ প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শনের পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ৫টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রও পরিদর্শন করেন। তাদের ইউএনএইচসিআরের বালুখালি ট্রানজিট ক্যাম্প, কুতুপালং মেইন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং আশ্রিত মহিলাদের স্থানসমূহ পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার শহরে বৈশ্বিক সংস্থা ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। সন্ধ্যার আগেই দুই সংস্থার এই দুই প্রধান ঢাকায় ফিরে যান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জাতিসংঘর শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধানের পদে থাকাকালীন ২০০৮ সালের ২৭ মে আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন এটা তার প্রথম। অনুরূপভাবে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম দুবছর আগে বাংলাদেশের সফর করেন। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন এই প্রথম। এদিকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এখনও মিয়ানমার প্রস্তুত নয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। সংস্থার প্রধান পিটার মাউরা আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে বলেছেন, রাখাইন সফরে গিয়ে তিনি যা দেখেছেন তাতে তিনি মনে করছেন না সহসা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। মাউরার এ বক্তব্যের বিপরীতে মিয়ানমার সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে রয়টার্স। রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়া বাতিল করার পর রাখাইন রাজ্যে মূল সাহায্য সহায়তা রেডক্রস থেকেই যাচ্ছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমারের পক্ষে এমন দাবি তোলার পর সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রম বাতিল করা হয়। এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে গত ৮ জুন মিয়ানমার ও জাতিসংঘের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি উপেক্ষিত রয়েছে। অফিসিয়ালি চুক্তির বিস্তারিত এখনও প্রকাশ না হলেও বিভিন্ন অন লাইনে তা বেরিয়ে গেছে। রয়টার্স বলেছে, প্রত্যাবাসন প্রশ্নে শরণার্থী কমিশনের একটি চিঠির অনুলিপিও তারা পেয়েছে। মিয়ানামর সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যকার সমঝোতা স্মারকলিপির অনুলিপির বিষয়ে সংস্থা জানিয়েছে, সই হওয়া গোপন চুক্তিতে দেশটিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান কিংবা স্বাধীন চলাচলের প্রকাশ্য নিশ্চয়তা নেই। নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা কি হবে তাও স্পষ্ট নয়। চুক্তির খসড়া অনুযায়ী রাখাইনে অন্য অধিবাসীদের মতোই প্রচলিত আইন মেনে স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার ভোগ করবে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা। তবে রাখাইন রাজ্যের সীমানার বাইরেও তারা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে কিনা সে নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এমনকি বর্তমানে যে আইন ও নীতিমালা দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার অধিকার রোধ করা হয়েছে এ নিয়ে সংশোধনের প্রতিশ্রুতিও ওই চুক্তিতে নেই। শুধু তাই নয় ৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের কার্যত যেভাবে রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে তা পর্যালোচনার কোন পরিকল্পনাও আপাতত নেপিদোর নেই।
×