ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীরবে গন্ধ বিলিয়ে যায়- নানা দেশে নানা নামে সবাই চেনে

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২৯ মে ২০১৮

নীরবে গন্ধ বিলিয়ে যায়- নানা দেশে নানা নামে সবাই চেনে

সমুদ্র হক ॥ সাদা পাপড়ির ওপর হলুদের ছোঁয়া। মায়াময় মিষ্টি সুগন্ধ। এই ফুল দেখে কখনই মনে হবে না ‘গোলাপ’। কেউ তা বলবেও না। বড়জোর চম্পা ফুল পর্যন্ত যেতে পারে। কেউ অবশ্য এই নামেও ডাকে। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো-বেশিরভাগ মানুষ ‘কাঠ গোলাপ’ নামেই ফুলটি চেনে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কাঠ গোলাপ ফোটে। বিশেষ করে নদী তীরের এলাকায় বেশি চোখে পড়ে। এই ফুলের সুবাস দিনের বেলায় যতটা না ভাসে সন্ধ্যার পর থেকে রাতভর দূরে থেকেও ফুলের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। পুষ্পপ্রেমিকরা হৃদয় ভরে সুবাস নেয়। ফুলের গন্ধে কবি সাহিত্যিকদের মনে কল্পনার শক্তি জেগে ওঠে। কেউ রাতেই লিখতে বসেন। দেশে এমন একটি ফুল ফোটে অবহেলায় অনাদরে। অনেকটা বনফুলের মতো। যে একবার এই ফুলের সুগন্ধ পেয়েছে তিনি ভুলতে পারেন না। তারা নগরীতে ফুলের দোকানগুলোতে এই ফুল খোঁজেন। পাওয়া যায় না। নার্সারিতে কালে-ভদ্রে এই ফুলের চারা মেলে। বগুড়ার সবচেয়ে বড় সবুজ নার্সারির স্বত্বাধিকারী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, তিনি কাঠ গোলাপের চারা বিক্রি করেন। জানালেন, কাঠ গোলাপ নামটি কীভাবে এসেছে এ নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। যতদূর জেনেছেন, তাতে এই ফুলটি করবী বংশোদ্ভুত। নাম কাঠ করবী। লোকের মুখে মুখে ফুলটি কাঠ গোলাপ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কাঠ করবী বললে কেউ কেনে না। পুষ্পপ্রেমী নাজমুন নাহার বললেন, করবী থাকায় মেয়েদের খোঁপায় ফুলটি মানায়। প্রণয়ের মানুষ তার প্রেমিকার খোঁপায় এই ফুল গুঁজে দেয়। উইকিপিডিয়া বলছে, কাঠ গোলাপের ইংরেজী নাম ‘ফানগিপানি’। এটি দ্বিপদ প্লুমিরিয়া। ফুলটি এ্যাপোসাইনেসিয়েয়ি পরিবারের সম্পূরক উদ্ভিদের নাম। কাঠ গোলাপের বৃক্ষ বিচিত্র গড়নের হয়। সাধারণত ৮ থেকে ১০ মিটার উঁচু। শাখা প্রশাখা খুব বেশি নয়। দেখে সহজেই বুঝে নেয়া যায় অন্যরকম বৃক্ষ। ফুলের বৈশিষ্ট্য অনেক। কোন ফুল বকের পালকের মতো সাদা। কোনটির সাদা পাপড়ির ওপর হলুদের ছোঁয়া। কোথাও হলুদের দানা। কোনটি লালচে। আবার সাদা রংয়ের কোন ফুল দীর্ঘ মঞ্জুরিদ-ের আগায় ঝুলে থাকে। কোনটি আবার গোলাপি রংয়ের। কোন কালে কোন পুষ্পপ্রেমী শক্ত পাপড়ির ওপর গোলাপি রং দেখেই নাম দিতে পারে কাঠ গোলাপ। সেই থেকে এই ফুল কাঠ গোলাপ নামটি বয়ে বেড়াচ্ছে। এই ফুলের অনেক গল্প আছে। ষোড়শ শতকে ইতালির এক পুষ্পপ্রেমী এই ফুল দেখতে পান এক দ্বীপে। তারই ধারাবাহিকতায় ফরাসী উদ্ভিদবিদ চার্লস প্লুমিয়ার ফুলের সুবাস পেয়ে সপ্তদশ শতকে পরিব্রাজক হয়ে দেশে দেশে ঘুরে আবিষ্কার করেন প্রতিটি দেশেই ফুলটি ফুটছে। পরে তার নাম অনুসারেই এই ফুলের গোত্র হয়। জেনেটিক নাম হয় প্লুমিরিয়া। একেক দেশে এই ফুলের একেক নাম। পারস্যতে নাম ইয়াসমিন, হিন্দি নাম চম্পা, গুজরাটে চাম্পো, মারাঠায় চাফা, মালয়লামে পলা চম্পাকাম, থাইল্যান্ডে লিলাওয়াদি, মালয়েশিয়ায় পরিটনাক, শ্রীলঙ্কায় আরালিয়া। ফিলিপিন্সে নাম কাকচিখি। হাওয়াই দ্বীপে নাম মিলিয়া। বর্তমানে হাওয়াই দ্বীপ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে। যারা হাওয়াই দ্বীপ ভ্রমণ করেন তাদের স্বাগত জানানো হয় এই মিলিয়া ফুল দিয়ে। মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা, কুক দ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, ফিজিতেও এই ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। দক্ষিণ ভারতের সকল অনুষ্ঠানেই এই ফুল সাজানো থাকে। সেখানে নাম কাঠ চম্পা। বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে অনেকে কাঠ গোলাপকে কাঠ চম্পাও বলে। সাদা কাঠ গোলাপ অনেকটা চাঁপা ফুলের মতো দেখতে হওয়ায় কেউ হয়তো এই নাম দিয়েছে। বৌদ্ধদের সংস্কৃতিতে এই ফুল প্রতিটি অনুষ্ঠানেই প্রয়োজনীয়। বৌদ্ধ মন্দিরে এই ফুল গাছ থাকতেই হবে। নিকারাগুয়া ও লাওসে এই ফুল জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। নিকারাগুয়ায় এই ফুলের নাম ‘সাকুয়ানজোশি’। লাওসে এই ফুলের নাম চামজা বা ডক চামজা। গাছ থেকে গাছে পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় এই ফুল ফোটে। বসন্ত কালে ফুল ফোটা শুরু হয়ে বর্ষা অতিক্রম করে। অনেক ফুলের ভিড়ে কাঠ গোলাপ নীরবে নিভৃতে গন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে।
×