ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ- গ্যাংস্টারদের গা ঢাকা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৫ মে ২০১৮

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ- গ্যাংস্টারদের গা ঢাকা

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ সরকারপ্রধানের কঠোর নির্দেশনা পেয়ে গত ৪ মে থেকে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দেশব্যাপী মাদক পাচার, মজুতকারী ও সেবনকারীদের বিরুদ্ধে যে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে এর সুফল দৃশ্যমান হচ্ছে জনমনে বহুল কাক্সিক্ষত আশায় ঝলক দিচ্ছে। শান্তিকামী মানুষ শুধু খুশি নয়, রীতিমতো উল্লসিত। সরকারের এ উদ্যোগ এবং কার্যকারিতা এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশ ও একটি জাতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যেতে যে মাদক অন্যতম একটি অনুষঙ্গ সেই মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরুর বিষয়টি শান্তিপ্রিয় মানুষ ইতিবাচক মনোভাবই দেখছে। সরকারী মহল বিশেষ করে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা ও র‌্যাবের পক্ষে এর কার্যকারিতা আশ্বস্ত করেছে। করেছে আশান্বিতও। পুরো বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত গ্যাং স্টারদের অনেকেই ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকেই নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, সরকারের অর্জনের ঝুলিতে এসেছে একের পর এক সফলতা। কিন্তু মাদকের চোরাচালান, ব্যবহার এবং এর পাশাপাশি চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী তৎপরতা যেভাবে গতি লাভ করেছে এর বিপরীতে সরকারের সফলতা বহুলাংশে যেন ম্লান হয়েই যাচ্ছিল। বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্র মতে, সরকারের নীতি নির্ধারক মহল বিষয়টি অনুধাবনে আনতে সক্ষম হওয়ায় সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত। সমাজ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসার পর এসেছে বহুল কাক্সিক্ষত কঠোর নির্দেশনা। ‘জিরো টলারেন্স’-ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্লোগানে এমন কার্যক্রম শান্তিকামী মানুষের মনে প্রত্যাশিত ছিল। শেষ পর্যন্ত তা এসেছে। কিন্তু ধরে রাখা যাবে কিনা তা নিয়েও মানুষ শঙ্কামুক্ত নয়। গত ৪ মে থেকে র‌্যাব যেভাবে মাদকের চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আটঘাট বেঁধে নেমেছে তা সর্বত্র সাধুবাদ কুড়াতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে মাদকের মধ্যে বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালানের গ্যাং স্টাররা প্রাণ রক্ষায় গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা চোরাচালানের গেটওয়ে হিসেবে চিহ্নিত কক্সবাজার অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা মাদক স¤্রাটরা এখন তটস্থ। ইতোমধ্যে চিহ্নিতরা যাতে দেশ ছাড়তে না পারে সে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও আরোপিত করেছে সরকার। এরপরও কেউ কেউ আগেভাগে পালাতে সক্ষম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে অধিকাংশ এখনও দেশঅভ্যন্তরে অবস্থান করছে গোপনীয়তায়। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের এমন উদ্যোগ দেশ ও জাতির জন্য বড় ধরনের ইতিবাচক ঝাঁকুনি বলেও আলোচিত হচ্ছে। কারণ মাদকের আগ্রাসনে দেশের অগণন পরিবার ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিপতিত। পক্ষান্তরে ইয়াবা চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত থেকে স্বল্পসংখ্যক অসাধু ব্যক্তি ও প্রশাসনের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজরা বিত্ত বৈভব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বহু আগে থেকেই ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের আগ্রাসন গোটা দেশকে মহাদুর্ভোগের হাতছানি দিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের মহা অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই মরণব্যাধি মাদকের ক্রমবিস্তৃতিই ঘটেছে, যা সকলের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক বলে বিবেচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় আবারও ঘোষণা দিয়েছেন, সারাদেশ থেকে মাদক নির্মূল করা হবে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে। পক্ষান্তরে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বৃহস্পতিবার ঢাকায় টেকনাফের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির নাম উল্লেখ করে বলেছেন, শুধু বদি নয়। আরও আছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরিকৃত লিস্ট অনুযায়ী আবদুর রহমান বদির নাম ছিল ইয়াবা চোরাচালানকারীদের শীর্ষে। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে বদির নাম বাদ পড়ে যায়। তবে তার সহোদরদের নাম রয়ে গেছে। আরও আছে বদির নিকটজনদের নামও। এদের প্রায় সকলেই এখন গা ঢাকা দিয়েছে। এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গোটা কক্সবাজার যেহেতু ইয়াবা চোরাচালানের গ্রেটওয়ে সেহেতু র‌্যাবের পক্ষে এই জেলায় বিশেষ করে উখিয়ায় টেকনাফে সহসাই শুরু হচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকের অভিযান। এ জেলার মাদক স¤্রাটদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। এরা এলাকায় প্রভাবশালীও বটে। প্রশাসনের বহু শীর্ষ কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে এদের কাছে বিক্রীত। ফলে দেশের প্রচলিত আইন কানুনকে এরা থোড়াই কেয়ার করে না। কিন্তু এবারের অভিযানের নেপথ্যের নির্দেশনা ভিন্নতর। যা মাদক স¤্রাটদের ভিত কাঁপতে শুরু করেছে। সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে থেকে যারা মাদক ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ রক্ষা করে এবং তাদের সহায়তা দিচ্ছে এমন বিভিন্ন সংস্থা কর্মকর্তা ও সদস্যদের তালিকা করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ সংস্থার সদস্যরাই বেশি। অন্য সংস্থার যারা জড়িত রয়েছে তাদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তবে এদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে নির্দেশনা মিলেছে। এদিকে সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও প্রায় ১৯ কোটি পিস ইয়াবার চালান উদ্ধার হয়েছে কক্সবাজারে। তবে ক্যারিয়ার বা গডফাদারদের কাউকে ধরা যায়নি। বরাবরের মতোই গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অপরদিকে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে যারা ইয়াবা চোরাচালানে জড়িত তাদের লিস্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে প্রশাসনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও গোটা দেশে ইয়াবার ঢল এসেছে বহু আগে থেকে। মিয়ানমারে যে বড় ৩৭টি ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে সেগুলো থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের সব ইয়াবা চলে আসে বাংলাদেশে। অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ এসব কারখানার মালিক। ফলে সে দেশের সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা পুলিশের বড় একটি অংশও ইয়াবা পাচারে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। পাচারে সহায়তার বিপরীতে তাদের হিস্যাও মিটিয়ে দেয়া হয়। আর এপারে থেকে যারা এমন গর্হিত কাজে জড়িত তাদের বিনিয়োগও মোটা অঙ্কের। ইয়াবা পাচারের লভ্যাংশের একটি ভাগ প্রশাসনের মধ্যে বিশেষ করে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা কর্মকর্তা ও সদস্যদের পকেটে পৌঁছে দেয়া হয়। গত ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী র‌্যাবের যুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর শান্তিকামী মানুষের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এর কার্যকারিতা কোন পর্যায়ে যাবে তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। এমন অভিযান নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিবাজ সদস্যরাও। কারণ অতীতের রেকর্ড অনুসন্ধান চালালে এদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব প্রকাশ হওয়ার পর এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত ৪ মে থেকে র‌্যাবের অভিযান দৃশ্যমান হওয়ায় শান্তিপ্রিয় সকল মহলে বহুল কাক্সিক্ষত স্বস্তির ঢেঁকুর ঢেউ খেলছে। সাধারণ মানুষ চায়, সরকার মাদকসহ সন্ত্রাসী সকল অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুক। গডফাদার চক্রের সঙ্গে চেইনের শেষটুকু পর্যন্ত নির্মূল করা হোক। সমূলে বিনাশ করা হোক সমাজবিরোধী এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকা সকল দুষ্টচক্রকে। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. অনুপম সেন বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, এ সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়নের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু বিভিন্ন অপকর্ম ও সমাজকে ধ্বংস করার অপতৎপরতায় জড়িতদের তালিকাও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে ঘোষণা দিয়েছেন এবং র‌্যাব দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে তা নিঃসন্দেহে একটি ভাল দিক। সাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কাজে যারাই জড়িত-তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ হলে এ সরকারের বিদ্যমান ভাবমূর্তি পর্বতসম পর্যায়ে যে পৌঁছে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্রগুলোও জানিয়েছে, বর্তমান সরকার এ দেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে উন্নীত করেছে। কিন্তু মাদকসহ সন্ত্রাসী তৎপরতার ক্রমবিস্তৃতির কারণে সরকারের সফল অর্জনের স্তম্ভগুলোর ঝিলিক ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছে। সঙ্গত কারণে সরকারের পক্ষে মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান যতই কঠোর ও কার্যকর হবে ততই সরকারের ভাবমূর্তি এদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনে ব্যাপকহারে রেখাপাত যে ঘটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেইÑ এমন আলোচনা এখন সর্বত্র।
×