ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী

আমরা ক্ষমতায় থাকলে তারা গণতন্ত্র দেখে না, বুটের লাথি ভাল লাগে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৮ মে ২০১৮

আমরা ক্ষমতায় থাকলে তারা গণতন্ত্র দেখে না, বুটের লাথি ভাল লাগে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দলের নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ৩৭ বছর হয়ে গেছে। একটি দলের সভাপতি হিসেবে ৩৭ বছরের বেশি থাকা সমীচীন হবে না। বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাদের চিন্তাভাবনা করতে বলেন এ সময়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার গণভবনে সকালে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা সমস্বরে ‘না না’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। শেখ হাসিনা হেসে বলেন, ‘নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবা উচিত।’ আবারও সবাই ‘না না’ বলে ওঠেন। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় শেখ হাসিনাকে আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রত্যয়সহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সর্বস্তরের মানুষের প্রাণঢালা ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছায় স্নাত হন শেখ হাসিনা। দিবসটি পালনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, শেখ হাসিনার সুন্দর জীবন ও দীর্ঘায়ু কামনা করে দেশব্যাপী দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আনন্দ শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ৩৭ বছর আগের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই দিনে তাঁর স্বদেশে ফিরে আসার স্মৃতি রোমন্থনে বার বারই আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনা বলেন, সেইদিন প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই তাঁকে বরণ করে নেয়ার জন্য রাজধানীতে মানুষের যে ঢল দেখেছেন, যে ভালবাসা পেয়েছেন তা তাকে এখনও আপ্লুত করে। মা-বাবা-ভাই, পরিজনদের হারিয়ে বাংলার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালবাসাই তাঁকে চলার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁদের আশ্রয়েই আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের পর প্রায় পৌনে ছয় বছর সপরিবারে ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। দেশে ফেরার আগে একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর থেকে টানা ৩৭ বছর ধরে দলের হাল ধরে আছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সংগঠনকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, যতক্ষণ আছি... সংগঠনকে শক্তিশালী করা দরকার। ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের পাশে থেকে আওয়ামী লীগের যে কোন কিছু অর্জন সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের কনফারেন্সে আমার অজান্তেই দলের সভানেত্রী করা হয়। নিজের ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো এত বড় দলের দায়িত্ব চাইনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে উঠে দাঁড়াবে, স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এটা যারা চায়নি তাদেরই এই ষড়যন্ত্র ছিল। তারা এই দেশটাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। যারা বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করেছেন, তাদের উদ্দেশে বলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। আর একটা শ্রেণী আছে, তাদের কিছুই ভাল লাগে না। তারা মিলিটারি ডিক্টেটরদের পা চেটে চলত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তারা গণতন্ত্র দেখে না। বুটের লাথি খেলে ভাল লাগে। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তাদের আমলে ডেমোক্রেসি থাকে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ কারা তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা নিজের ভাগ্য গড়ার জন্য রাজনীতি করেননি। প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারবার বাধা এসেছে, আসবে। এটাই স্বাভাবিক। হত্যার (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা) বিচার করেছি। ষড়যন্ত্রের তদন্ত হয়নি, বিচার হয়নি। তিনি বলেন, মৃত্যুকে আমি পরোয়া করি না। ভয় পাই না। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। এ বিচার করতে গিয়ে যারা সাক্ষী দিয়েছেন তাদের ওপরও অনেক সময় অত্যাচার হয়েছে। কাজেই এ মামলার সাক্ষীদের ওপর যেন কেউ অত্যাচার করতে না পারে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। যদি কেউ সাক্ষীদের নির্যাতন বা অত্যাচার করেন তাহলে তাদেরও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (সর্বোচ্চ শাস্তি) হবে। জাতির পিতা হত্যাকা- এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট থাকার জন্যও দলের নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা হত্যার বিচার করেছি, কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিচার তো হয়নি, তদন্তও হয়নি। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।’ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ঐক্যবদ্ধ থেকে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্র্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, সংগঠন যদি শক্তিশালী হয়, সংগঠনে যদি ঐক্য থাকে আর এই সংগঠন যদি জনগণের পাশে থেকে জনমত সৃষ্টি করতে পারে তখনই যেকোন কিছু অর্জন করা সম্ভব হয়। এটা আমরা বার বার প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশে ফেরা থেকে শুরু করে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে ক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে তা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া এবং দেশের গণতন্ত্রায়ন ও নিরন্ন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য। ছাত্র রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনের দায়িত্ব নেয়াটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক কঠিন সময়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। জাতির পিতার খুনীরা তখন পুরস্কৃত হয়ে বহাল তবিয়তে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স থাকায় পিতা হত্যার বিচার চাইতে পারছেন না, জিয়া তখন নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে দেশ চালাচ্ছে। আর ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে আওয়ামী লীগকে। ১৯টি ক্যু করে সেনাবাহিনীর বহু মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার-সৈনিকদের হত্যা এবং বিমানবাহিনীর ৫৬২ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে জিয়াউর রহমান। অনেকে জানে না (ষড়যন্ত্রের বিষয়ে) ছুটিতে বাড়িতে ছিল তাদেরকে ধরে নিয়ে এসে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে মারা হয়েছে। জিয়াউর রহমান হত্যাকা-ের পর সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যার ষড়যন্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়ন করা হয়। দলের ভেতরের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জিয়া চট্টগ্রামে নিহত হন। জিয়া নিহত হওয়ার পর বিচারের নামে প্রহসন করে ১২ জন তরুণ অফিসারকে মারা হলো। অনেকে কিছুই জানে না ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছে তাকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী যারা দেশের গণতন্ত্র দেখতে পান না, তাদের কঠোর সমালোচনা করে এদেরকে সামরিক সরকারগুলোর পদলেহনকারী ও সুবিধাভোগী বলে উল্লেখ করেন। বলেন, অবৈধভাবে দল গঠনের মধ্যে তারা গণতন্ত্র পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কতটুকু দিতে পারলাম, কতটুকু করব সেটাই বড় কথা। যতক্ষণ আছি, সংগঠনকে শক্তিশালী করা দরকার। প্রথমে দলের সিনিয়র নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় অন্যদের মধ্যে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এবং ডাঃ দিপু মনিসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এরপর একে একে প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন এবং মহিলা শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীরা শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রীকে। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে সকালে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সর্বস্তরের মানুষ।
×