ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চ রক্তচাপ মারাত্মক শারীরিক জটিলতার কারণ হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ মে ২০১৮

উচ্চ রক্তচাপ মারাত্মক শারীরিক জটিলতার কারণ হতে পারে

ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ, ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ॥ অন্যান্য বছরের মতো এবারও ১৭ মে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ পালিত হচ্ছে। দিন দিন উচ্চ রক্তচাপ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তবে আক্রান্তের অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারে না। প্রায়ই উচ্চ রক্তচাপ একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ এ রোগ ভাল হয় না। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দুটাই জরুরী। অন্যথায় বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কি? স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো সেই বল; যার সাহায্যে রক্ত শরীরের একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছায়। হৃদপিণ্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ তৈরি হয়, যার একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একেক মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক এই রক্তচাপও বিভিন্ন রকম হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুমের সময় এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এই পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ সময় রক্তচাপের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরেই থাকে। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। যদি কারও রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। উচ্চ রক্তচাপ কি আসলেই কোন জটিল ব্যাধি? উচ্চ রক্তচাপ ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোন প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না এবং এটাই এর সবচাইতে ভীতিকর দিক। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোন লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ হলে কি কি জটিলতা হতে পারে? রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন হৃদপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিউর। রক্তনালী সঙ্কুচিত হয়ে হার্ট এ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, কিডনি নষ্ট হয়ে রেনাল ফেইলিউর, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হতে পারে, যা থেকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়া চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে। কি কি কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়? ৯০ ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপের কোন নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারী বা এসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়ে থাকে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বাড়ায়, যেমন * বংশানুক্রমিক : উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। * ধূমপান : ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। * অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ : খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্ত চাপও বেড়ে যায়। * অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা : যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলে অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে। * অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার; যেমন মাংস, মাখন এবং ডুবা তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, যার ফলে রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। * অতিরিক্ত মদ্যপান : যারা নিয়মিত অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করে তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়। এ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরি থাকে; এর ফলে ওজন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। * ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস রোগীদের এ্যাথারোস্ক্লেরোসিস বেশি হয়। ফলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে। * অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা : অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারে, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে। কিছু কিছু রোগও উচ্চ রক্তচাপের কারণ। একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো- * কিডনির রোগ। * এ্যাড্রেনাল ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, থাইরয়েডের রোগ। * ধমনীর বংশগত রোগ। * গর্ভধারণ অবস্থায় এ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি এ্যাকলাম্পসিয়া হলে। * অনেকদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ খেলে। উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কি করা উচিত? জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, তা কমানো সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এ রকম ক্ষেত্রে যে সব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। নিম্নে কিছু প্রয়োজনীয় টিপস দেয়া হলো। * অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে : খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভাল। * খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা : কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাসি বা গরুর গোশত, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননি তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভাল। আটার রুটি এবং সুজিজাতীয় খাবার পরিমাণ মতো খাওয়া ভাল। * লবণ নিয়ন্ত্রণ : তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। * ধূমপান বর্জন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানোও পরিহার করতে হবে। * মদ্যপান : অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে। * নিয়মিত ব্যায়াম : সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি। * ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। * মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে : নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের সখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। নিজ ধর্মচর্চার মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। * রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা : নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা যায় এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ততই জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া হতে রক্ষা পাওয়া যায়। * যে সমস্ত ওষুধ ব্যবহারে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া তা কোনক্রমেই ব্যবহার করা যাবে না। উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে? উচ্চ রক্তচাপ নিরাময়যোগ্য নয়, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। অনেক রুগী কিছুদিন ওষুধ খাবার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভাল হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারো কারো ধারণা, একবার ওষুধ খেলে তা আর বন্ধ করা যাবে না। আবার কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোন সমস্যা করছে না বা রোগের কোন লক্ষণ নেই; তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। মনে করেন ভালই তো আছি, ওষুধের কি দরকার? এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। এই ধরনের রোগীই হঠাৎ করে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক করতে হবে।
×