ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

‘মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ছিলেন বাংলা ও বাঙালিত্বের পূজারী’

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৫ মে ২০১৮

‘মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ছিলেন বাংলা ও বাঙালিত্বের পূজারী’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বহুমাত্রিক পরিচয়ের এক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। একাধারে ছিলেন ভাষাসৈনিক, লেখক, গবেষক ও সম্পাদক। সদ্যপ্রয়াত এই কীর্তিমান মানুষটিকে স্মরণ করা হলো সোমবার। তাকে নিবেদিত নাগরিক শোকসভায় বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের এক অগ্রণী পুরুষ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তিনি ছিলেন কালের সাক্ষী এবং বাংলা ও বাঙালিত্বের পূজারী। তার গবেষণাকর্ম আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যোগ করেছে বুদ্ধিবৃত্তিকতার নবতর মাত্রা। তার জীবন কেবল সময়ের দিক থেকে দীর্ঘ নয়; উল্লেখযোগ্য কর্মের অর্জনেও বিশিষ্ট।’ সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে শোকসভায় মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কবি আজিজুর রহমান আজিজ, মুক্তিযুদ্ধ একাডেমির সভাপতি আবুল আজাদ প্রমুখ। পরিবারের পক্ষে কথা বলেন তার বড় ছেলে মুস্তাফা ইমরুল কায়েস ও বোন শামীম শবনম দীপ্তি। উপস্থিত ছিলেন তার কন্যা নন্দিতা ইয়াসমিন, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফাহিম হোসেন চৌধুরী। মুস্তাফা নূরউল ইসলামের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালন করা হয় দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতা। আনিসুজ্জামান বলেন, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবন বর্ণাঢ্য। তিনি শিক্ষকতা, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, সাময়িকপত্র সম্পাদনা, গবেষণা এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি এক সময়ে নাট্যান্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসাধারণ রসবোধের গুণ। এদেশের প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় মুস্তাফা নূরউল ইসলামের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুস্তাফা ইমরুল কায়েস বলেন, বাবা হারানো সবার জন্যই বেদনার। বাবা আমাদের কাছে বন্ধুর মতো ছিল। তার পরামর্শ নিয়েই আমরা পথ চলি। তিনি বলতেন, কখনই পেছনে ফিরে তাকাবে না, সামনের দিকে তাকাবে। শামসুজ্জামান খান বলেন, তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় মানুষ। প্রথম জীবনে ‘অগত্যা’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে কট্টর পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে তীর্যকভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে কিছুদিন কাজ করার পর নানা চক্রান্তের শিকার হন। কিন্তু তারপরও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি সারাজীবন যে কাজই করেছেন, সেখানেই বাঙালী জাতিসত্ত্বার উন্মেষে কাজ করেছেন। রামেন্দু মজুমদার বলেন, তার জীবনের দুইটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি তার সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা; ‘অগত্যা’, ‘পূর্বমেঘ’, ‘সুন্দরম’- এ তিন সাহিত্য সাময়িকীর প্রতিটিই খুব গুছিয়ে, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, তার বাচনভঙ্গি ও উপস্থাপনা। ‘মুক্তধারা’, ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তিনি বহুমাত্রিক কাজের মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রগতির চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন কালের সাক্ষী ও পথ প্রদর্শক। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু জাতীয় যেকোন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। শামীম শবনম দীপ্তি বলেন, আমি ১১ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট, তিনি ছিলেন সবার বড়। তার আদর-মমতায় বড় হয়েছি। তিনি কখনও হার মানতেন না। অন্য বক্তারা বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের এক অগ্রণী মানুষ, কালের সাক্ষী। তিনি ছিলেন বাংলা ও বাঙালিত্বের পূজারী। সাময়িকপত্র গবেষণা, নজরুল গবেষণা এবং বাঙালী মুসলিম-মানসের আধুনিকায়ন বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যোগ করেছে বুদ্ধিবৃত্তিকতার নবতর মাত্রা। গত ৯ মে ৯২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। পর দিন ১০ মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বস্তরের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্মজয়ন্তী উদযাপন ॥ বাংলাভাষার চলচ্চিত্রে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন তিনজন পুরোধা চলচ্চিত্রকার। সেই তিন চলচ্চিত্রকারের অন্যতম একজন মৃণাল সেন। অপর দুইজন হলেনÑ বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক কুমার ঘটক। এই তিনজনের মধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক। চলচ্চিত্রের ভুবনে এখনও বাতিঘর হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন মৃণাল সেন। সোমবার ছিল এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের ৯৬তম জন্মজয়ন্তী। এদিন মৃণাল সেনকে নিবেদিত আলোচনা ও তার নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদ্্যাপিত তার জন্মদিন। সোমবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ডিজিটাল আর্কাইভে মৃণাল সেনের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। আমৃত্যু শোষকের বিরুদ্ধে লিখেছেন শওকত ওসমান ॥ বাংলা কথাসাহিত্যে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন শওকত ওসমান। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিল দেশবরেণ্য এই কথাসাহিত্যিকের কলম। সোমবার ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ এই কথাসাহিত্যিকের কুড়িতম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘর ও কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ স্মরণসভা বিকেলে জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, আমৃত্যু শোষকের বিরুদ্ধে লিখেছেন শওকত ওসমান। কথা বলেছেন শোষিতের পক্ষে। পথ চলেছেন প্রগতির পক্ষে। স্মরণসভায় শওকত ওসমানকে নিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক এবং ড. বেগম আকতার কামাল। পিতৃস্মৃতিচারণ করেন শওকত ওসমানের ছেলে জাঁনেসার ওসমান। সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, শওকত ওসমানের জীবন ছিল সংগ্রামী। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। এ লেখক নিজে প্রগতির পথে হেঁটেছেন এবং জাতিকে সে পথে নিতে চেষ্টা করেছেন। আমৃত্যু শোষকের বিরুদ্ধে লিখেছেন। কথা বলেছেন শোষিতের পক্ষে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি জাতির মননকে বুঝে দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করেছেন। লেখক রূপকধর্মী লেখা লিখতেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাঁসি’ আদমজী পুরস্কার পায়। অথচ তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বুঝতেই পারেনি এ রচনা তাদের বিরুদ্ধেই লেখা। শওকত ওসমান সব সময়ই রূপকধর্মী লেখা লিখতে পছন্দ করতেন। তার সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের সচেতনতা বাড়ানো উচিত। বেগম আকতার কামাল বলেন, শওকত ওসমান জীবনে আশাবাদী ও ইতিবাচক ছিলেন। তিনি সময়কে নিয়ে চমৎকারভাবে খেলা করেছেন তার লেখনীর মধ্যে। এ লেখক প্রকৃতি ও প্রযুক্তি, দুটো বিষয়েই সচেতন ছিলেন এবং মানব মুক্তির জন্য সাধনা করেছেন আজীবন। আয়োজনের শুরুতে শওকত ওসমানের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় জাদুঘরের কীপার শিহাব শাহরিয়ার। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাদুঘরের সচিব মোঃ শওকত নবী, কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ রকিবুল ইসলাম লিটুসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
×