ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০ নারী হত ॥ সাতকানিয়ায় ইফতার সামগ্রী ও যাকাত নিতে গিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৫ মে ২০১৮

১০ নারী হত ॥ সাতকানিয়ায় ইফতার সামগ্রী ও যাকাত নিতে গিয়ে

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/বিকাশ চৌধুরী ॥ পবিত্র রমজানের প্রাক্কালে সাতকানিয়ায় গরিব ও দরিদ্রদের মাঝে ইফতার এবং যাকাত সামগ্রী বিতরণের বিশাল আয়োজন করেছিল চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ কেএসআরএম (কবির স্টিল এ্যান্ড রি- রোলিং মিলস) কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিতরণ শুরু করার পরক্ষণে ঘটে যায় মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইফতার ও যাকাত সামগ্রী গ্রহণের জন্য হাজির হয়েছিল ৩০ সহস্রাধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। ফলে ব্যাপক ভিড় সৃষ্টি হয়। এদের ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিল নারী। একদিকে প্রচ- গরম, অপরদিকে মানুষের ওপর মানুষ ঠাসা হয়ে ইফতার ও যাকাত সামগ্রী নিতে গিয়ে হিট স্ট্রোক, ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১০ জন। আহত হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক। নিহতদের সকলেই নারী। এদের সকলেরই বয়স ১৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাসউদুল কবিরকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অপরদিকে, কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শাজাহান নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৩ লাখ টাকা এবং আহতদের পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া নিহতদের পরিবারগুলোর সদস্যদের কেএসআরএম গ্রুপে চাকরিদানের আশ্বাস প্রদান করেছেন। সাতকানিয়া উপজেলার সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের কাদেরিয়া মঈনুল উলুম হেফজখানা ও এতিমখানাসংলগ্ন মাঠে মর্মান্তিক প্রাণহানির এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানায় জড়িতদের পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে রমজান ও ঈদের আগে ইফতার সামগ্রী এবং যাকাত ফিতরা বিতরণের আয়োজন করা হয়। তবে এর আগে ২০০৭ সালেও এমন একটি আয়োজনে প্রাণ হারিয়েছিল ৬ জন। এলাকা সূত্রে জানা গেছে, এবারের ইফতার ও যাকাত সামগ্রী বিতরণের প্রাক্কালে গত কয়েক দিন ধরে নলুয়া ইউনিয়নের প্রায় মসজিদে ইমামদের মাধ্যমে এই আয়োজনের তথ্য জানান দেয়া হয়। কর্মসূচী উপলক্ষে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসা ময়দানে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ৮০ সদস্যের সিকিউরিটি গ্রুপও নিয়োজিত করা হয়। প্রস্তুতি রাখা হয় চিকিৎসক ও এ্যাম্বুলেন্সেরও। তবে থানা পুলিশকে বিষয়টি অবগত করা হয়নি বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ প্রশাসন। অবশ্য ঘটনার পর শতাধিক পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের নিয়োজিত করা হয় নিহত ও আহতদের উদ্ধারে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। ঘটনার পর পর ইফতার ও যাকাত সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচী বন্ধ করে দেয়া হয়। আহতদের দ্রুত স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও গুরুতরদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ১০ জনই ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে গুরুতর আহত বাকপ্রতিবন্ধী মোস্তফা খাতুনকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গুরুতর আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয় বলে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানানো হয়েছে। যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত ॥ কেআরএসএম গ্রুপের মালিকানায় যারা জড়িত তাদের বাড়ি সাতকানিয়া নলুয়া ইউনিয়নের গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রমজানের আগে তারা ইফতার ও যাকাত সামগ্রী বিতরণের কর্মসূচী গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শাহজাহান নিজেই এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন। ইফতার সামগ্রী বিতরণের পূর্ব ঘোষণা জেনে সাতকানিয়ার বিভিন্ন গ্রাম পাশ্ববর্তী উপজেলা লোহাগাড়া উপজেলা এমনকি পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বিভিন্ন স্থান থেকে রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে বিতরণস্থলে হাজির হওয়া শুরু হয়। রাতভর মাদ্রাসা মাঠের বাইরে তারা লাইন ধরে অবস্থান করে। অনেকে রাতের খাবার ও সকালের নাস্তাও গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। প্রচ- গরম ও ভিড়ের চাপে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়ে। এরপরও যাকাত সামগ্রীর আশায় তারা লাইন ছাড়েনি। সোমবার সকালের মধ্যে ইফতার সামগ্রী গ্রহণে আগ্রহীর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এদের অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন বয়সের নারী ও যুবতী। অল্পসংখ্যক ছিল পুরুষ ও শিশু। সকাল ১০টার আগে বিপুলসংখ্যক নারী মাদ্রাসা মাঠ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় বিতরণ। মাদ্রাসা মাঠের বাইরে তখন এ সংখ্যা আরও প্রায় তিনগুণেরও বেশি। মাঠের প্রবেশ মুখে ছিল লোহার গেট। একপর্যায়ে হুড়োহুড়ি ও ধাক্কাধাক্কিতে গেটটি ভেঙ্গে যায়। এরপরই ইফতার সামগ্রী গ্রহণে আগতরা একে অপরের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকে। ফলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ১০ জন। আহত হয় অর্ধশতাধিক। ঘটনার পরই এলাকার লোকজন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এরপর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ ইলিয়াস হোসেন ও পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনাসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। এদিকে, কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক। কর্তৃপক্ষের সকল প্রস্তুতি ছিল। ২০ সহস্রাধিক মানুষের মাঝে প্যাকেট বিতরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ইফতার সামগ্রী গ্রহণে মানুষের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তিনি আরও জানান, একদিকে প্রচ- গরম, অন্যদিকে ভিড় এবং এর পাশাপাশি হুড়োহুড়ি করে হামলে পড়ায় শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। ঘটে যায় অনাকাক্সিক্ষত মর্মান্তিক প্রাণহানির এ ঘটনা। তিনি আরও জানান, ইফতার সামগ্রী বিতরণের এ কর্মসূচী প্রতিবছর চলে কেএসআরএম মালিকানার সঙ্গে জড়িতদের পারিবারিক উদ্যোগে। মালিকদের পক্ষে ইতোমধ্যেই নিহত ও আহতদের আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাকরির সংস্থানের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। এদিকে, পুলিশ জানিয়েছে, কেএসআরএম গ্রুপ প্রতি বছর রমজান ও ঈদের প্রাক্কালে এ ধরনের ইফতার ও যাকাত সামগ্রী বিতরণ করে থাকে। এবারের এ বিশাল আয়োজনের প্রাক্কালে বিষয়টি পুলিশকে আগেভাগে অবহিত করা হয়নি বলে দাবি করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) এমরান ভুঁইয়া। এছাড়া এলাকাবাসীর পক্ষে দাবি করা হয়েছে, এ বিশাল কর্মযজ্ঞে তাদেরকেও সংযুক্ত করা হয়নি। কেআরএসএম কর্তৃপক্ষ নিজেদের লোকজন ও সিকিউরিটি সদস্যদের নিয়ে এ আয়োজন করে। সাতকানিয়ার বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে, যাকাত ফেতরা গ্রহণের জন্য এত পরিমাণ মানুষ ওই উপজেলায় নেই। এরপরও এত বিপুলসংখ্যক মানুষ কোথা থেকে এল তা তাদের কাছে বোধগম্য নয়। আর কেআরএসএম কর্তৃপক্ষও মসজিদে মসজিদে ইমাম মুয়াজ্জিনদের মাধ্যমে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর ইফতার সামগ্রী বিতরণের বিষয়টি জানান দেয়ার ফলে তা এককান দুইকান হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। এতে করে সাতকানিয়ার বাইরের এলাকা থেকেও লোকজন চলে আসে বলে নিশ্চিত ধারণা দেয়া হয়। তবে হিট স্ট্রোক, হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কির যত কথাই বলা হোক না কেন, অধিকাংশের প্রাণপাত যে পদদলিত হয়ে হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ নিহতদের অনেকের মুখে ও শরীরে বিভিন্ন ধরনের আঘাতপ্রাপ্তির চিহ্ন রয়েছে। অপরদিকে, জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, এ ঘটনা নিয়ে গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। কমিটির রিপোর্টের পরই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে আপাতত বিষয়টি থানায় জিডি করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে রমজান মাসে যাকাত ফেতরা গ্রহণে আগ্রহীদের ভিড়ের চাপে প্রাণহানির বেশ কয়েকটি ঘটনা রয়েছে। যার মধ্যে কেএসআরএমের এ ধরনের কর্মসূচীতে দুদফায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে যাদেরকে পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ গ্রহণের আবেদন জানাবে তাদেরকে হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া যাদের পরিচয় চিহ্নিত হবে না তাদের ডিএনএ টেস্টের পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের ৯ জন হচ্ছে- পাশ্ববর্তী লোহাগাড়া উপজেলার ফাতেমা বেগম (১৬), ফাতেমা আকতার টুনটুনি বেগম (১৫), নূর জাহান (১৮), সাতকানিয়া উপজেলার রীনা বেগম (৩০), হাসিনা আকতার (৩০), রশিদা আকতার (৫৪), সাথি আকতার (২৪) ও জোৎ¯œা বেগম (২৫)। বান্দরবান উপজেলার নূর আয়েশা (৫০)। আরেকজনের নাম জানা যায়নি। গুরুতর আহতদের মধ্যে মোস্তফা খাতুন (৬০), হোসনে আরা বেগম (৪৪), জুনু মিয়া (৪০), রাজিয়া বেগম (৫৫), রোকেয়া বেগম (৩৫), দিলুয়ারা বেগম (৪০), সাকিব (১২) এর নাম জানা গেছে। তারা বর্তমানে সাতকানিয়া উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
×