ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

নৈরাজ্যের নেপথ্যে ॥ পরিবহন বাণিজ্যে রাজনৈতিক প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

নৈরাজ্যের নেপথ্যে ॥ পরিবহন বাণিজ্যে রাজনৈতিক প্রভাব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হাতে নেই পরিবহন সেক্টর! রাজনৈতিক নেতাদের কব্জায় দেশের গোটা পরিবহন খাত। অর্থাৎ পরিবহনে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য। এই খাতে চলমান নৈরাজ্যের নেপথ্যে অনেকাংশেই রাজনৈতিক প্রভাবকেই দায়ী করা হয়। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মেয়র, কাউন্সিলর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় বেশিরভাগ পরিবহন। অনেক সময় তাদের আত্মীয় স্বজনদের নামেও পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। নেপথ্যে থাকে মূল শক্তি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার ৯৮ ভাগ পরিবহন এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আত্মীয়দের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া আন্তঃজেলা রুটেও এ চিত্র ৬০ ভাগের বেশি। পুলিশ, বিআরটিএ কর্মকর্তা, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নসহ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণেই পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরছে না। মানা হচ্ছে না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোন নিয়মনীতি। ফলে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। মালিকদের প্রভাবে চালকরাও বেপরোয়া। সেইসঙ্গে আইনের দুর্বলতায় দুর্বল শাস্তির বিষয়তো রয়েছেই। অনেকের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের তৎপরতায় মিলছে যানবাহনের সহজ রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস ও রুট পারমিট। বিভিন্ন রুটে আধিপত্য বিস্তারের কাজ করছেন তারাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুট নির্ধারণ, সিটিং সার্ভিসে ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানিরও অন্যতম কারণ পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। সরকারী দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার সম্মিলিত তৎপরতার কাছে জিম্মি গণপরিবহন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নও গঠন করা হচ্ছে। মালিক সমিতির অলিখিত নির্দেশে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএকেও হিসেব করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণে কোন কোন সময় মালিক সমিতির হস্তক্ষেপের অভিযোগ মিলেছে। অভিযোগ আছে, প্রতি জেলায় রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি ও (আরটিসি) গঠন করা হয় দলীয় বিবেচনায়। তাছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় ও অর্থের বিনিময়ে বিআরটিসি রুট নির্ধারণ করে থাকে। তাদের সদিচ্ছা ছাড়া ব্যবসা সফল রুটে গাড়ি চালানোর অনুমতি মেলা ভার। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় রাজীবের মৃত্যুর জন্য দায়ী স্বজন পরিবহন কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও পাশে দাঁড়ায়নি। চালক গ্রেফতার হলেও সবকিছু মিটমাটের চেষ্টা চলছে প্রভাবশালী কোম্পানি মালিকদের চেষ্টায়। বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোজিনার বাস চালককে আটক করেছিল পুলিশ। সেও এখন মুক্ত। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, অনেক মালিকের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও পরিবহন সেক্টরে রাজনৈতিক প্রভাব খুব একটা নেই। আমি মনে করি নিয়ম অনুযায়ী পুরো সেক্টর চলছে। কেউ যদি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে এজন্য পরিবহন ব্যবসায়ীরা দায়ী নন। তিনি বলেন, অপরাধ যেই করুন তাকে শাস্তি পেতে হবে। এখানে প্রভাব বিস্তারের কিছু নেই। আইন চলবে তার নিজস্ব গতিতে। তবে পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন প্রবীণ শ্রমিক নেতা আলী রেজা। তিনি বলছেন, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কারণে পরিবহন সেক্টরে বিশৃঙ্খলা চলছে। সব রুটের চিত্র একই। তিনি বলেন, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোতে প্রভাব বিস্তারেরও চেষ্টা করছে মালিক সমিতি। মালিক সমিতির সুপারিশ ছাড়া বিআরটিএ গাড়ির ব্লু বুক দেয়া, গাড়ি ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করতে পারে না। এজন্য অলিখিত নির্দেশনা আছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও চালকদের কিছু হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। মালিক সমিতি বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ম্যানেজ করে আদালতে দুর্বল চার্জশীট দেয়। ফলে অপরাধীরা ছাড়া পায়। জামিনে বের হয়। কিন্তু মালিকরা সবকিছু থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এক বিআরটিএ কর্মকর্তা অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সব অভিযোগ সত্য নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মালিক সমিতির হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতি প্রভাব বিস্তারের কথা স্বীকার করেন তিনি। মাঠে আছে বিএনপিও ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি মির্জা আব্বাসের মালিকানা ছিল ‘ঢাকা পরিবহন’। সেই পরিবহনের ব্যবসা এখন ভাল নয়। বিএনপির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি জি এম সিরাজ ‘এসআর পরিবহনের’ মালিক। ‘হানিফ পরিবহনের’ মালিক সাভারের বিএনপি নেতা কফিল উদ্দিন ও তার ভাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি মোহাম্মদ হানিফ। বিএনপির আরেক সাবেক এমপি এস এ খালেকের মালিকানাধীন পরিবহন খালেক এন্টারপ্রাইজ। বিএনপির সূত্রাপুর থানার নেতা আরিফের রয়েছে প্রিন্স পরিবহন। পরিবহন বাণিজ্যে জাতীয় পার্টি ॥ এদিকে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিও পরিবহন ব্যবসায় পিছিয়ে নেই। জাতীয় পার্টির রংপুরের নেতা ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সঞ্চিতা পরিবহনের মালিক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির (মালিকদের সংগঠন) সভাপতিও তিনি। জাতীয় পার্টির অপর নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ এসএ পরিবহনের মালিক। ঢাকা-ফেনী পথে চলাচলকারী স্টারলাইন পরিবহনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের টিকেট নিয়ে ফেনীর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি তিনি নৌ পরিবহনেও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। বিএনপি সরকারের আমলে তৎকালীন মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তার মালিকানাধীন বাস ছিল ঢাকা পরিবহন ও ঢাকা-ময়মনসিংহ গন্তব্যের সৌখিন পরিবহন। বর্তমানে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বর্তমান সরকারের আমলে পরিবহন সেক্টরের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ও বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির শীর্ষ নেতা তিনি। ইতোমধ্যে তিনি সরকারী দলের একটি ইউনিটের নেতৃত্বও পেয়েছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে তার ‘এনা পরিবহন’ নামের বাস চলে। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একজন। ঢাকার ৯৮ ভাগ পরিবহন আওয়ামী লীগ নেতাদের ॥ রাজধানীর প্রায় ৯৮ ভাগ পরিবহন ব্যবসা এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। আবার পুরনো পরিবহন ব্যবসায়ীদের অনেকেই নিজের পরিচয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক পদ-পদবির তকমা লাগান। মূলত প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যেই এই রাজনৈতিক তকমা। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে বর্তমানে পরিবহন কোম্পানির সংখ্যা ২৪৬। প্রায় সাত হাজার বাস নগরীসহ আশপাশের এলাকায় চলাচল করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানসহ তার পরিবারের সদস্যরা পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। মন্ত্রীর ছোট ভাই আজিজুর রহমানে খানের পরিচালনায় চলছে ‘কনক’ পরিবহন। তারা সাত ভাইয়ের তিনজনসহ মন্ত্রীর শ্যালকও পরিবহন বাণিজ্যে যোগ দিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথও ‘বিহঙ্গ’ পরিবহনের মালিক। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি পরিবহন বাণিজ্যে যোগ দেন। নারায়াণগঞ্জের সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমানের পরিবহনের নাম ‘জেড এন কর্পোরেশন’ ও বন্ধন পরিবহন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে এসি এই পরিবহনটি চলাচল করছে। ঢাকা উত্তর যুবলীগের সভাপতি মাঈনুল হোসেন খান ‘চলন’ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের পরিবহন কোম্পানির নাম ‘মোহনা’ পরিবহন। ল্যাম্পস পরিবহনও আওয়ামী লীগের এক নেতার। ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান ‘দেশ বাংলা’ পরিবহনের চেয়ারম্যান। এছাড়া তিনি ঢাকার কাউন্সিলরও। শরিয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা একেএম ইসমাইল হকের ‘গ্লোরী’ পরিবহন। সাবেক সরকারদলীয় সাংসদ আশরাফুন নেসা মোশারফের ‘স্বপ্ন সার্ভিসেস’। আওয়ামী মোটরসাইকেল লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কালু শেখের রয়েছে তিনটি বাস কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে ‘ওয়েলকাম’, ‘মৌমিতা’ ও ‘স্বজন’ পরিবহন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হকের ভিআইপি ক্ল্যাসিক। প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন সাবেক এমপি শাহিদা তারেক দিপ্তী। ‘জাবালে নূর’ পরিবহনের কর্ণধার হলেন মন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক। ‘ক্যান্টনমেন্ট পরিবহন’ নিয়ন্ত্রণ করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার বোন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন দলের নেতাদের বাস চলাচল করছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর বাস কোম্পানির নাম ‘মেঘালয়’। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাকুরা পরিবহনের মালিক চুন্নু মিয়া, গ্রীন সেবা, দোলা ও হিমাচল পরিবহন কোম্পানি জামায়াত সমর্থিত মালিকানার, সিলেট ও চট্টগ্রাম রুটে চলা আল মোবারকার মালিক আরিফ ও রাশেদ। তাদের একজন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও অপরজন বিএনপি সমর্থিত। ‘ডিপজল’ পরিবহনের মালিক মনোয়ার হোসেন ডিপজল বর্তমানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হলেও এক সময় তিনি বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর ছিলেন। ইকনো পরিবহনের মালিক বিজন বর্ধন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ আওয়ামী লীগ সমর্থিত। অনাবিল, ছালছাবিল পরিবহনের মালিক জামায়াত সমর্থিত। রংধনু পরিবহন জামায়াত সমর্থিত। সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিক সমিতির নেতা। রাজনৈতিক হিসেবে নিকাশ করেই পথচলে গ্রীন লাইন পরিবহন। জানতে চাইলে হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা, রুট পারমিটসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস মালিকরা রাজনৈতিক তদবির করেন এটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য। দিন দিন এর প্রভাব বাড়ছে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের গণপরিবহনগুলো আইনকানুন কিছুই তোয়াক্কা করে না। আর এখানে মালিকদের এমন একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে যারা কোন না কোন রাজনৈতিক আশ্রয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে এ সেক্টরে অনিয়ম বাড়ছে। রাজনৈতিক নেতারা পরিবহন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় এ খাতে নিয়মনীতি কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
×