ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মীর আব্দুল আলীম

দুর্ঘটনার নামে হত্যাকাণ্ড নয়

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

দুর্ঘটনার নামে হত্যাকাণ্ড নয়

এ দেশে কত শত রাজীবের হাত যাচ্ছে, পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে। মিশুক-মনির, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছে না সড়ক দানবের মৃত্যু মিছিল। আমরা বিশেষ দু’-একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী-এমপিরা ছুটে যায় স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে? সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে তো মরছেই। রোধ হচ্ছে না। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কিন্তু অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়কে আইন মানছে না কেউ। আসলে সড়কে আইন মানতে বাধ্য করা হয় না। তাহলে কিভাবে সড়কে নৈরাজ্য থামবে? এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবনা কম। যারা সড়কে আইন মানানোর কাজ করেন তারাই আইন মানেন না। পত্রিকায় দেখি, সড়কে ঘুষের মহোৎসব চালায় পুলিশ। তাদের ব্যস্ত সময় নাকি কাটে উপড়ি কামাইয়ে। সড়কে আইন না মানা ড্রাইভার, পথচারীদের নিয়ন্ত্রণে তাদের চিন্তার সময় কোথায়? তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ হবে কি করে? আমরা কি অন্ধ? আমরা কি কালা (কানে কম শুনি)? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে সংবাদ ছাপছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মড়ক লাগায় জাতীয় প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকা গত দেড় বছর ধরেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশেষ সংবাদ ছাপছে। সবাই দেখে, সবাই দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবে। কিন্তু যাদের এ নিয়ে ভাবনা থাকার কথা তারাই ভাবে না। তারা দেখেনও না, বললে শোনেনও না। এ দেশের মানুষগুলোও চরম বেহায়া। তাদের স্বজনরা মরছে, পঙ্গু হচ্ছে কিন্তু তারাও সচেতন হচ্ছে না। প্রতিবাদী হচ্ছে না। এ দেশে কারণে অকারণে কোটা নিয়ে প্রতিবাদ হয়, রাজনৈতিক বিষয়ে প্রতিবাদ হয়, কেউ গ্রেফতার হলে প্রতিবাদ হয়, মানুষ খুন হলে প্রতিবাদ হয়, কারণে অকারণে হরতাল অবরোধ হয়, কিন্তু প্রতিদিন একই কায়দায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ খুন হলেও সবাই চুপ থাকে। এ দেশে প্রতিবাদেরও মানুষ নেই। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কেন দেশের মানুষ মারবে? ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে থাকলে, অড্রাইভার (লাইসেন্সবিহীন) গাড়ি চালালে, সড়কের নিয়ম না মানলে তো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবেই। মানুষ তো মরবেই, হাত, পা, নাক, মুখ, কান, চোখ হারাবেই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সবাই প্রতিবাদী হোক। ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, নার্স, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ সবাই সড়কের নৈরাজ্য রোধে রাস্তায় নামুক। পাড়া, মহল্লায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কমিটি করে অড্রাইভার, ত্রুটিপূর্ণ এবং অবৈধ যানবাহনের গতি রোধ করে দিক। আর ঘরে বসে থাকা ঠিক হবে না। সড়ক নৈরাজ্য রোধে দেশের প্রতিটি মানুষের সড়কে নামা উচিত। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো মৃত্যুদূত, ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন এদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, দেখতে পাই স্বজন হারানোদের আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোন দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, তাতে নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। প্রতিদিন সড়কে এমন হত্যাকা- ঘটলেও সংশ্লিষ্টদের কাছে এটি গা-সওয়া হয়ে গেছে; সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে নেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। তাই, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকা- চলছে। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা, সে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনা কিন্তু প্রাকৃতিক নয় বরং মানবসৃষ্ট। যার কারণে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সে হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার হন। কিন্তু, হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাক্সিক্ষত উদ্যোগ নেই বাংলাদেশে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। এমন কোন দিন নেই, যে দিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু ঘটলে এ জন্য চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু, পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা গেছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এ দেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। উৎকোচ কিংবা অর্থ ভাগাভাগির মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটেছে এসব ঘটনার। সরকারী হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর গড়ে মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে পুলিশ এ তথ্য দিয়েছে। বেসরকারী হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যায় প্রায় ৫৫ জন। পুলিশের দেয় তথ্য ও বেসরকারীভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ রেকর্ডভুক্ত করে না। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে যানবাহন দুর্ঘটনায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং আহত ও পঙ্গু হয়ে পরনির্ভরশীল জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এর চাইতেও অনেক বেশি মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশসমূহের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে আর তা রোধ করা যাচ্ছে না কেন? অদক্ষ ও দুই নম্বরী লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকগণই যে এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিকার করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী নয় কেন? এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অপরাপর জানমাল রক্ষায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে শতকরা ৭০ জনের জীবনসহ অসংখ্য আহত ও ডলারে কেনা পরিবহন রক্ষায় সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাহিনী গঠন করছে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যথাসম্ভব দ্রুত ভাবতে হবে। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় দুর্ঘটনা রোধে নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল, ২. মোবাইল ফোন ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা ইত্যাদি। আর এসব কারণে প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা। দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে। যে কোন মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি। লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
×