ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের ৯ স্থানে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২২ এপ্রিল ২০১৮

দেশের ৯ স্থানে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র চূড়ান্ত

রশিদ মামুন ॥ দেশে বাতাসবিদ্যুত উৎপাদনের উপযোগী। পূর্ণাঙ্গ উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং (বায়ু মানচিত্র) প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের নয়টি এলাকার বাতাসের গতিবেগ ৫ থেকে ৬ মিটার/ সেকেন্ড। বায়ুতাড়িত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যাকে আদর্শ বলা হচ্ছে। যদিও এর আগে মনে করা হতো বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব নয়। সর্বনিম্ন ২৪ থেকে ৪৩ মাসের গড় বায়ু প্রবাহের ফল বিশ্লেষণ করে দেশে বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল)। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শক্তি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল হক বলেন, সারা বিশ^ই এখন নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। এক সময় জীবাশ্ম জ¦ালানি শেষ হয়ে যাবে। তখন আমাদের নবায়নযোগ্য জ¦ালনিতে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে। এখন অনেক আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। কাজেই এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, সরকারের কাছে ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানি বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করছে। শীঘ্রই বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্রের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর বিদ্যুত উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়া হবে। এর আগে জল এবং সৌরবিদ্যুত ছাড়া তেমন কোন নবায়নযোগ্য জ¦ালানি বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহার করা হতো না। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে বায়ুপ্রবাহের যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তা এনআরইএল পর্যালোচনা করছে। সম্প্রতি এনআরইএল প্রকল্প পরিচালক মার্ক জ্যাকবসন যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, বায়ুপ্রবাহের গড় ৫ থেকে ৬ মিটার/সেকেন্ড। জ্যাকবসন তার রিপোর্টে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনের উপযোগী বলে মনে করছেন। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, চূড়ান্ত বায়ু মানচিত্রের ফল নিয়ে একটি সেমিনার করে সবদিক তুলে ধরা হবে। সেখানে উদ্যোক্তাদেরও আহ্বান জানানো হবে। প্রাথমিকভাবে প্রতি মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে দিন দিন এই খরচ কমে আসছে। যেহেতু বায়ুই বিদ্যুত উৎপাদনের প্রধান উপকরণ তাই কোন জ¦ালানি খরচ নেই। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের বিদ্যুত উৎপাদন খরচ একেবারে কমিয়ে আনা সম্ভব। সব মিলিয়ে দেশের নয়টি স্থানে টাওয়ার স্থাপন করে বায়ুপ্রবাহর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এক বছর থেকে ৪৩ মাস পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নয় স্থানের মধ্যে ২০১৪ সালে পাঁচটি এবং ২০১৫ সালের চারটি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। টাওয়ারগুলোর মধ্যে ৪৩ মাস ধরে নাটোরের লালপুরের বায়ুপ্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ৮০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের একটানা গতিবেগ পর্যালোচনা করা হয়। একইভাবে ৪৩ মাস ধরে চাঁদপুর সদরের জাফরাবাদে টাওয়ার স্থাপন করে বায়ুপ্রবাহর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে ৬০ মিটার উচ্চতায় টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের ইনানী বিচে স্থাপন করা টাওয়ার দিয়ে ৪০ থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত বাতাসের অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। এখানে ১২ মাসের গতিবেগ পরীক্ষা করা হয়। সীতাকুণ্ডে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ৮০ মিটারের একটি টাওয়ার স্থাপন করা হয় সেখানে ২৪ মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে পার্কি বিচে একই উচ্চতার একটি টাওয়ার স্থাপন করা হয়; সেখানে ৩৬ মাস ধরে পরীক্ষা চলে। বদরগঞ্জে ২০ থেকে ২০০ মিটারের নানা ধরনের টাওয়ার স্থাপন করা হয়। ২০১৫ সালের আগস্টে স্থাপন করা এসব টাওয়ার থেকে ২৪ মাসের তথ্য নেয়া হয়। একই সময়ে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ৮০মিটারের টাওয়ার স্থাপন করে ২৯ মাসের তথ্য নেয়া হয়। হবিগঞ্জের মধুপুর চা বাগানে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ৮০ মিটার উচ্চতায় টাওয়ার স্থাপন করা হয়। সেখানে ২৬ মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে খুলনার দাকোপে ৮০ মিটার উচ্চতার টাওয়ার স্থাপন করা হয়। এটিও ২৬ মাস ধরে তথ্য বাছাই করা হয়েছে। নয়টি স্থান থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাউন্ড ডিটেকটিভ এ্যান্ড রেঞ্জিং (এসওডিএআর) পদ্ধতিতে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য বাছাইয়ের পর মডেলিং ওয়ার্কের কাজ করে এনআরইএল। ইউরোপীয় দেশগুলো ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। এর মধ্যে বায়ু, জল এবং সৌরবিদ্যুত উৎপাদনকে গুরুত্ব দিচ্ছে উন্নত বিশ^। ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ¦ালানি ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় আগেভাগে নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের দেশে ৩২ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এক হাজার ২শ’ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে, সেখানে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, বায়ু দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনে হাইব্রিড প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে এক্ষেত্রে খরচ আরও কমে আসবে। বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বায়ুর সঙ্গে সৌর এবং ডিজেল সংমিশ্রণে হাইব্রিড প্রকল্প হাতে নিলে উৎপাদন খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণে বছরে আট মাস অর্থাৎ মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বায়ুপ্রবাহ থাকে। এই সময়ে বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। বাকি চারমাস অর্থাৎ নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি দক্ষিণে না থাকলেও উত্তরাঞ্চলে বায়ুপ্রবাহ ভাল থাকে। যেহেতু গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সঙ্কট বেশি থাকে এই সময়ে বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনকে লাভজনক বলে মনে করা হয়। পাওয়ার সেলের পরিচালক (টেকসই জ¦ালানি) আব্দুর রৌফ মিয়া বলেন, বায়ুবিদ্যুত উৎপাদন করতে হলে একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাপিং দরকার; এতদিন সেটা ছিল না। সাধারণত ২ দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার/সেকেন্ড হলেই বায়ুবিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব; সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। কিন্তু ৫ থেকে ৬ মিটার/সেকেন্ড বাতাসের গতিবেগ হলে বিদ্যুত উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব। তিনি বলেন, এখন আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে একটি টারবাইন দিয়ে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এখন আমাদেরও এসব বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে জানান তিনি।
×