ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন দিগন্তে পারমাণবিক চুল্লি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ এপ্রিল ২০১৮

নতুন দিগন্তে পারমাণবিক চুল্লি

ড. জাকিয়া বেগম ॥ সবুজ শক্তির উৎস হিসেবে খ্যাত পারমাণবিক স্থাপনায় বিদ্যুত উৎপাদন প্রক্রিয়া গ্যাস বা কয়লাচালিত বিদ্যুত স্থাপনার মতো একই ধরনের হলেও দুটি প্রধান পার্থক্যের কারণে পারমাণবিক স্থাপনায় অধিক উন্নত কিছু প্রযুক্তির সংযোজন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে। প্রধান পার্থক্য হচ্ছে তাপশক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। অন্যান্য স্থাপনায় জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করা হয় কিন্তু পারমাণবিক চুল্লিতে সাধারণত ‘ফিশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৌলিক পদার্থের পরমাণুকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটানো হয় যার ফলে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসটি ভেঙ্গে প্রচুর তাপশক্তি উৎপাদিত হয়। এই তাপশক্তি দ্বারা পানিকে বাষ্পে রূপান্তরিত করে বাষ্প-চালিত ঘূর্ণন-যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়। শৃঙ্খল বিক্রিয়া অত্যন্ত প্রবল ও দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে। উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে এই বিক্রিয়াকে সুনিয়ন্ত্রিত করে তুলে বিস্ফোরণ ঠেকানো ও নির্দিষ্ট মাত্রায় শক্তি উৎপাদন করার ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় পার্থক্য হচ্ছে যেহেতু পারমাণবিক বিক্রিয়ার কারণে চুল্লিতে ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও কণা নির্গত হয় তাই তেজস্ক্রিয় সম্পাতের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষ ও পরিবেশ রক্ষায় এই চুল্লিতে বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পদ্ধতির সংযোজন ঘটানো হয়। এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত পারমাণবিক চুল্লির সবগুলোই ‘ফিশন বিক্রিয়া’র উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলোতে জ্বালানি হিসেবে সাধারণত ইউরেনিয়াম বা সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ইউরেনিয়ামের উপজাত হিসেবে উৎপাদিত প্লুটোনিয়াম বা থোরিয়ামও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পারমাণবিক চুল্লির ক্ষেত্রে সাধারণত জ্বালানিগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির নলের মধ্যে ভরে জ্বালানি দ- তৈরি করে সেগুলোকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আবদ্ধাবস্থায় চুল্লির কেন্দ্রে রাখা হয় যাকে ‘রিএ্যাক্টর কোর’ বলা হয়। চুল্লি থেকে শৃঙ্খল বিক্রিয়ার কারণে উচ্চশক্তি ও দ্রুত গতিসম্পন্ন নিউট্রন বের হয়ে আসে যেগুলোর গতি মন্থর করে পুনরায় শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটানোর পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য তীব্রতা হ্রাসকারী ‘মডারেটর’ (মন্থরক) ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্রিয়ার হার কমানো বা একেবারে বন্ধ করে দেয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ দ- বা ‘কন্ট্রোল রড’ ব্যবহার করা হয়। কেন্দ্রে অবস্থিত কোর-এ উৎপাদিত তাপ পরিবহনের মাধ্যমে শীতল করে তোলার জন্য কোর-এর চতুর্দিকে পানি বা অন্য কোন তরল পদার্থ প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয় যাকে বলা হয় ‘কুল্যান্ট’ অর্থাৎ শীতলকারী। রিএ্যাক্টর কোরটি ‘মডারেটর’ও কুল্যান্টসহ স্টিলের তৈরি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত আঁধারের মধ্যে রাখা হয়। নিয়ন্ত্রণ দ-গুলো প্রয়োজন মতো এই আঁধারের মধ্যে ঢোকানো বা বের করে নেয়া যায়। চুল্লিতে ‘মডারেটর’ এবং ‘কুল্যান্ট’ হিসেবে উচ্চ চাপ মাত্রার তরল পানি ব্যবহার করা হলে স্টিলের আধারটি উচ্চচাপ সহিষ্ণু করে তৈরি করা হয় যাকে ‘রিএ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল’ বলা হয়। সবধরনের রিএ্যাক্টরে এ ধরনের ‘প্রেসার ভেসেল’ থাকে না। পারমাণবিক বিক্রিয়ার ধরন, জ্বালানির ধরন ও গাঢ়ত্ব, শীতলীকরণ পদ্ধতি ও মডারেটরের বিভিন্নতা, ব্যবহারের বিভিন্নতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক চুল্লিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। বিক্রিয়ার ধরনগত ভিন্নতার ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ ॥ ফিশন বিক্রিয়া অব্যাহতভাবে ধরে রাখার জন্য যে নিউট্রনগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর শক্তির মাত্রার উপর নির্ভর করে পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। থারমাল রিএ্যাক্টরস : এগুলোতে ধীরগতি বা কম শক্তিসম্পন্ন থারমাল নিউট্রন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে প্রচলিত বেশির ভাগ চুল্লিই এ ধরনের। ফিশন প্রক্রিয়া থেকে উদ্ধুদ্ধ উচ্চ গতিসম্পন্ন নিউট্রনের গতি হ্রাস করার ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ ধরনের মডারেটর ব্যবহার করা হয় যেগুলোর সাহায্যে নিউট্রনগুলোর গতি পারিপাশির্^ক অন্যান্য কণাসমূহের গতির পর্যায়ে কমিয়ে আনা হয় এবং এ অবস্থাকে তাপীয় সাম্যাবস্থা বলা হয়। এক্ষেত্রে থারমাল নিউট্রনগুলোই ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর সঙ্গে শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপ উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। দ্রুত গতির নিউট্রন রিএ্যাক্টর : এ ধরনের চুল্লির জ্বালানিতে ফিশন ঘটানো হয় দ্রুত গতির নিউট্রন দ্বারা। এগুলোতে মডারেটর থাকে না এবং এমন ধরনের শীতলীকারক ব্যবহার করা হয় যেগুলো খুব অল্প মাত্রায় নিউট্রন মন্থরক হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে নিউট্রনের শক্তি ১ কিলোভোল্টের বেশি হয়ে থাকে। ব্রিডার রিএ্যাক্টর : সাধারণ চুল্লিতে ফিশন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য যে পরিমাণ বিভাজন যোগ্য পদার্থ (ফিসাইল ম্যাটেরিয়াল) ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা থাকে ব্রিডার রিএ্যাক্টর তার চেয়ে বেশি পরিমাণে বিভাজন যোগ্য পদার্থ তৈরি করে যেমন; ইউরেনিয়াম-২৩৮ প্লুটোনিয়াম-২৩৯, অথবা থোরিয়াম-২৩২ পদার্থগুলো ইউরেনিয়াম-২৩৩-তে রূপান্তরিত হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে একবার ফিসাইল পদার্থ দ্বারা চুল্লি চালু করার পর পুনর্বার জ্বালানি সরবরাহের প্রয়োজনীয়তার সময় প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম বা ব্যবহৃত (ডিপ্লেটেড) ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা যায়। থোরিয়াম ব্রিডার রিএ্যাক্টরের ক্ষেত্রে থোরিয়াম ব্যবহার করা হয়। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া দ্বারা চালিত চুল্লি : এ ধরনের চুল্লি এখনও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়নি তবে গবেষণাগারে এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের চুল্লিতে একাধিক হালকা পরমাণু নিউক্লিয়াসের সংযুক্তি ঘটিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত ভারি নিউক্লিয়াস এবং প্রচুর শক্তি উৎপাদন করা হয় এবং উৎপাদিত শক্তি চুল্লির জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। শীতলীকরণ পদার্থের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ ॥ থারমাল রিএ্যাক্টরের (এলডব্লিউআর) ক্ষেত্রে শীতলীকরণের জন্য ব্যবহৃত পদার্থটি মডারেটর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শীতলীকরণের জন্য সাধারণ পানি (ঐ২ঙ) ব্যবহার করা হলে তাকে ‘লাইট ওয়াটার রিএ্যাক্টর’ এবং ভারি পানি (উ২০) ব্যবহার করা হলে তাকে ‘হেভি ওয়াটার রিএ্যাক্টর’ বলা হয়। এ ধরনের চুল্লিতে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামকে বিশেষ পদ্ধতিতে স্বল্প মাত্রায় সমৃদ্ধ করা হয় অর্থাৎ ২৩৫-ইউরেনিয়ামের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যিকভাবে ৪৪৭টি পারমাণবিক চুল্লি বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহার করা হচেছ যার মধ্যে ২৯০টি হচ্ছে প্রেসারাইজড্ ওয়াটার রিএ্যাক্টর (পিডব্লিউআর) এবং ৭৮টি বয়েলিং ওয়াটার রিএ্যাক্টর (বিডব্লিউআর)। এই দুই ধরনের রিএ্যাক্টরই ‘লাইট ওয়াটার রিএ্যাক্টর’-এর অন্তর্ভুক্ত। প্রেসারাইজড্ ওয়াটার রিএ্যাক্টর : এ ধরনের চুল্লির ক্ষেত্রে পারমাণবিক জ্বালানি, মডারেটর, কুল্যান্ট এবং নিয়ন্ত্রণ দন্ডগুলো উচ্চ চাপ সহিষ্ণু আঁধারের (প্রেসার ভেসেল) মধ্যে রাখা হয়। ‘কুল্যান্ট’ এবং মডারেটর হিসেবে ব্যবহার করা হয় উচ্চ চাপমাত্রার তরল পানি। প্রেসার ভেসেল থেকে বের হয়ে আসা উত্তপ্ত তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পানি স্টিম জেনারেটরের সঙ্গে যুক্ত প্রাথমিক একটি ‘লুপ’-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয় যা দ্বিতীয় একটি ‘লুপ’-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানিকে বাষ্পায়িত করে তোলে। এই বাষ্প দ্বারা টারবাইন ঘূর্ণনের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। বয়েলিং ওয়াটার রিএ্যাক্টর : শীতলীকারক এবং মডারেটর হিসেবে এক্ষেত্রেও পানি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রেসার ভেসেলটি অনেক কম চাপে থাকে এবং ভেসেলটির মধ্যেই পানিকে বাষ্পয়িত করা হয়। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক লুপের প্রয়োজন থাকে না। ‘লাইট ওয়াটার রিএ্যাক্টর’-এ বিভিন্ন ধরনের মডারেটর ব্যবহার করা হয়। মডারেটরের ধরনের উপর ভিত্তি করেও চুল্লি শ্রেণী বিভক্ত করা হয়। যেমন- গ্রাফাইট মডারেটেড রিএ্যাক্টরেট মডারেটর হিসেবে গ্রাফাইট ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের চুল্লিতে ‘কুল্যান্ট’ হিসেবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করা হলে তাকে ‘গ্যাস কুলড্ গ্রাফাইট মডারেটেড রিএ্যাক্টর’ আর পানি ব্যবহার করা হলে তাকে ‘ওয়াটর কুলড্ গ্রাফাইট মডারেটেড রিএ্যাক্টর’ বলা হয়। প্রেসারাইজড হেভিওয়াটার রিএ্যাক্টর : এই চুল্লিগুলোতে মডারেটর এবং কুল্যান্ট উভয় ক্ষেত্রেই ভারি পানি এবং জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। কানাডার তৈরি এ ধরনের বিশেষ চুল্লির নাম ‘কানডু’। ‘ফাস্ট ব্রিডার রিএ্যাক্টর এ দ্রুতগামী নিউট্রন ব্যবহার করায় মডারেটরের প্রয়োজনীয়তা থাকে না এবং শীতলীকারক হিসেবে তরল ধাতু বিশেষ করে তরল সোডিয়াম ব্যবহার করা হয়। বর্তমান বিশ্ব এখন পর্যন্ত এই ছয় ধরনের পারমাণবিক চুল্লিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে নিরাপত্তা ও জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যকে বিবেচনায় রেখে আরও কয়েক ধরনের চুল্লি তৈরির প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।
×