ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ এপ্রিল ২০১৮

ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার চেষ্টা

রহিম শেখ ॥ বছরখানেক আগেও ব্যাংকে ছিল অলস টাকার পাহাড়। ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলো ঘুরেছিল বিনিয়োগকারীদের দ্বারে দ্বারে। সুদহারও কমিয়ে আনা হয়েছিল এক অঙ্কে। কিন্তু অনেকটা হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে ব্যাংকিং খাতের চিত্র। তীব্র তারল্য সঙ্কটে পড়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। বিশেষ করে বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো। আর এই সঙ্কট মেটাতে বাড়তি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক। এই সুযোগে ঋণের সুদহারও এখন দুই অঙ্কের ঘরে। হঠাৎ ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে চাইছে সরকার। সম্প্রতি দুই দফায় ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে সরকারী ব্যাংকগুলোকে নিয়ে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর। নির্দেশনা দিয়েছেন সুদহার কমানোর। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানোর জন্য আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ঋণ বিতরণের লাগাম টানতে সম্প্রতি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সাড়ে ৮৩ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ৮৯ টাকা করা হয়েছে; যা আগে ছিল ১০০ টাকার বিপরীতে যথাক্রমে ৮৫ ও ৯০ শতাংশ। ২০১৯ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে বাড়তি ঋণ নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশের কারণে ব্যাংকগুলো এখন আমানত বাড়িয়ে এডিআর সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। কোন কোন ব্যাংক নতুন ঋণ অনুমোদন কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেক ব্যাংক ভোক্তাসহ কিছু খাতে ঋণ বিতরণ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ গত বছরও ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা অলস পড়েছিল। সে সময় বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে অফার দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৫৭ বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যেকটির সুদহার ১১ শতাংশের উপরে। সরকারী জনতা, বেসিক, কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী দুই ধরনের ঋণেই সুদ ১৩ শতাংশ। সোনালী ও রূপালী ব্যাংক নিচ্ছে ১১ শতাংশ হারে। আর অগ্রণী ও বিডিবিএল ব্যাংক সুদ নিচ্ছে ১১ থেকে ১২ শতাংশ হারে। তবে শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে এই সুদ কোন কোন বেসরকারী ব্যাংকে ২০ শতাংশের উপরে। বেসরকারী ব্র্যাক ব্যাংকে এই সুদহার প্রায় ২২ শতাংশ। এছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকে এসএমই খাতে সুদহার ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। আর দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী ঋণে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই অঙ্কের সুদে ঋণ দিলেও গড় হিসাবে (কাগজে-কলমে) কিছু ব্যাংকের সুদহার এখনও দেখাচ্ছে ৯ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতে ২২ ব্যাংকের সুদহার গড়ে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। জানা গেছে, সাধারণত ব্যাংকের সুদহার কত হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয় না। ব্যাংকগুলো নিজেরাই তাদের ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয় না। ব্যাংকগুলো তাদের মতো সুদহার নির্ধারণ করে। তবে আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধানের (স্প্রেড) বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। এটি পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে গড় আমানতের সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক বেশি। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারিতে ঋণের সুদহার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ঋণের সুদহার বেড়েছে দশমিক ১৩ শতাংশ। জানা গেছে, ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের নিচে রাখার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে তা মানছে না। এদিকে ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এখন ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। তাই সময় থাকতেই যেন সুদহার কমিয়ে আনা হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংক ঋণে সুদের হার ডবল ডিজিটে অবস্থান করায় আমরা উদ্বিগ্ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখতে নতুন বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। সাধারণত নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধনের যোগান প্রাথমিকভাবে ব্যাংকগুলোই দিয়ে থাকে। এদের সুদের হার বেশি হলে নতুনরা উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটের সুস্পষ্ট কারণ ব্যাংকগুলো দেখাতে পারেনি। ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ কমার কারণে তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে এটি গ্রহণযোগ্য অজুহাত নয়। ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন- এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান (এবিবি) ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে ব্যাংকের ঋণের সুদহার কমাব। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাবও মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, কস্ট অব ফান্ড বেড়ে গেছে। এখন ঋণের সুদহার কমালে ব্যাংক লোকসানে পড়বে। আর ব্যাংক লোকসানে পড়লে পুরো অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে চলমান তারল্য সঙ্কট নিরসনে নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসের ১৫ তারিখ থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ফেরত পেয়েছে ব্যাংকগুলো। ফেরত পাওয়া অর্থ যেন বিনিয়োগে যায় এ জন্যই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের এমডিদের ডেকে পাঠান গবর্নর ফজলে কবির। ওই বৈঠকে সরকারী ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন গবর্নর। এদিকে ঋণের সুদহার কমানোর জন্য আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। এর আগে সুদহার কমিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি দিয়েছে এফবিসিসিআই। গবর্নর বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসার অনুরোধ জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠন। আর এজন্য চলতি মাসের শুরুতে বৈঠকে বসারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সেই চিঠির কোন জবাব না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বৈঠকে বসা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সুদের হার। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। যাতে দ্রুত ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট নিরসন করে সুদ কমানো হয়। সম্প্রতি গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, আপনারা তো ব্যাংকের মালিক। আপনাদের তো সুযোগ-সুবিধা আমরা দিয়ে যাচ্ছি, আপনারা ব্যাংকের সুদের হার কমান। ব্যাংকের সুদের হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে এক ডিজিটের মধ্যে আনুন। ওই অনুষ্ঠানে বেসরকারী ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে অচিরেই কাজ শুরু করব; কিভাবে এ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা যায়। তিনি বলেন, এখন কিছু ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটেই রয়েছে। এর মধ্যে রফতানি ঋণের সুদের হার ৮ শতাংশ। এভাবে কিছু ক্ষেত্রে এ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা যাবে। আমরা ওই বিষয়ে কাজ শুরু করব।
×