জনকণ্ঠ ফিচার ॥ দেশের পাহাড়ী জেলাগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হচ্ছে বৈসাবি উৎসব। খাগড়াছড়িতে চলমান এই উৎসবের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার পাহাড়ী গ্রামে গ্রামে চলছে ত্রিপুরাদের গরয়া নৃত্যের সুর ঝংকার। পাহাড়চূড়ার ‘দেবতা পুকুর’-এ পূজা অর্চনা। আর ঘরে ঘরে বইছে পাঁচনের সুবাস। বান্দরবানে শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে চলছে সাংগ্রাই উৎসব। রাঙ্গামাটিতে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হচ্ছে পাহাড়ীদের মূল উৎসব বিজু। সব মিলে দেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং অন্যান্য অঞ্চল মেতে উঠেছে বাংলা নববর্ষের নানান ধরনের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে। সব মিলিয়ে সর্বত্র সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ী-বাঙালী সম্প্রীতির অদ্ভুত মেলবন্ধন...।
জীতেন বড়ুয়া খাগড়াছড়ি থেকে জানান, খাগড়াছড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হচ্ছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রধান ও বৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবি। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে চলে চাকমাদের মূল বিজু। আর ত্রিপুরাদের গ্রামে গ্রামে বেজে ওঠে গরয়া নৃত্যের সুর-ঝংকার, আর পাহাড়চূড়ার ‘দেবতা পুকুর’-এ পূজা অর্চনা। ঘরে ঘরে পাঁচনের সুবাস। বৈসাবি ঘিরে খাগড়াছড়ি এখন পরিণত হয়েছে পাহাড়ী-বাঙালী মিলন মেলায়। ঘরে ঘরে চলছে অতিথি আপ্যায়ন। নতুন পোশাকে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। দেবতা পুকুরে বসেছে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মেলা।
শুক্রবার বৈসাবি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে খাগড়াছড়ির মহালছড়ির মাইচছড়িতে পাহাড়ের প্রায় ১ হাজার ফুট উঁচু চূড়ায় অবস্থিত দেবতা পুকুরের পাদদেশে বসেছে (ত্রিপুরা ভাষায় যা মাতাই পুখরী) ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মেলা। সকাল থেকে হাজার-হাজার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী দেবতা পুকুরে সমবেত হচ্ছে। চারদিকে মালভূমি দ্বারা পাহাড় বেষ্টিত হওয়ায় দেবতা পুকুরকে সমতল ভূমি মনে হয়। সব চেয়ে আচর্য্যরে বিষয়, এ পুকুরের পানি কখনো কমে না। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস এইদিনে পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত পুকুরে স্নান করে দেবতাকে পূজা করলে বিশেষ মনোবাসনা পূরণ হয়। এ সময় ঘরে থাকা পরিবারের অন্যরা বুনোফুলের মালা দিয়ে ঘর সাজায় পরিপাটি করে।
এছাড়া ত্রিপুরাদের হারিবৈসু উপলক্ষে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াচ্ছেন, বিশেষ নাচের দল ‘গরয়া’। একেকটি দলে ৫০ থেকে ৬০ জনের নৃত্যশিল্পীরা পাহাড়ী জনপদে ঢোল আর বাঁশির সুরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ঐতিহ্যদীপ্ত ঝংকার। আবার কেউ কেউ পুণ্যার্জনের লক্ষ্যে পাড়ি জমান জেলা সদরে নুনছড়িতে অবস্থিত তীর্থস্থান ‘দেবতা পুকুর’-এ।
বৈসাবি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উৎসব হলেও এ অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীরাও উৎসবের আনন্দ একাকার হয়ে উপভোগ করছে। আর মারমা গ্রামে চলছে লুপ্তপ্রায় খেলাধুলা। কাল থেকে শুরু হবে মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
বৈসাবি মানেই রঙে বর্ণে বৈচিত্র্যময় এক সাংস্কৃতিক উৎসব। বিজু-সাংগ্রাই- বৈসু, যে নামেই বলা হোক না কেন, এই উৎসব যেন পাহাড়ীদের প্রেরণা-পাহাড়ের জাগরণ। বংশ পরম্পরায় পালিত এই উৎসবের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আর বাংলা’র মিশেলে বৈসাবি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন অন্য এক পাহাড়িয়া উৎসবে।
এস বাসু দাশ, বান্দরবান থেকে জানান, পুরনো বছরকে পেছনে ফেলে আসা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বান্দরবানের মারমা আদিবাসীরা সাংগ্রাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর তাদের ঘরে সাংগ্রাই আসে নতুন সাজে, দিয়ে যায় কিছু আনন্দ, কিছু বেদনার ফুলঝুরি। ঐ আনন্দ বেদনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রতিটি আদিবাসী’র দেহমনে জেগে উঠে নতুন পরিবর্তনের শিহরণ, স্বপ্ন দেখে দিন বদলের, স্বপ্ন দেখে যেন নতুন এক সকালের। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে নাচগান, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাসহ সপ্তাহব্যাপী নানা আয়োজনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বান্দরবানের আদিবাসীরা।
এরই অংশ হিসেবে শুক্রবার সকালে জেলা শহরের রাজার মাঠ থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ফের রাজার মাঠে এসে শেষ হয়। উক্ত শোভাযাত্রায় পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি, জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন, পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদারসহ স্থানীয় আদিবাসী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় আদিবাসী তরুণ তরুণীরা বর্ণিল পোশাকে নানা রঙের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। পরে রাজার মাঠে বয়োজ্যেষ্ঠ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার ১৪ এপ্রিল সাঙ্গু নদীতে বুদ্ধ মূর্তি স্নান, ১৫ এবং ১৬ এপ্রিল পুরাতন রাজবাড়ি মাঠে পানি বর্ষণ উৎসবের মধ্যে দিয়ে জেলার ৭টি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ী পল্লীতে মারমারা সাংগ্রাইয়ের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব (জলকেলি) মেতে উঠবে।
জলকেলি উৎসবের সময় তরুণ-তরুণীরা নির্ধারিত মঞ্চে অবস্থান করে। তরুণীদের সামনে বিভিন্ন পাত্রে বা জলাধারে জল রাখা থাকে। ঐ সময় তরুণেরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে দলে দলে এসে ‘সাংগ্রাইতে মিলে মিশে পানি খেলাখেলি ও ভাই সকলে ও বোন সকলে এসো একত্রে আনন্দ করি’। লেঃ লেঃ লেঃ.. লেঃ .. মংরো মংরোঃ.. মংরো মংরো, পেং পাদাউশে পোওয়াংরে লা সাংগ্রে, ক্যালোঃ মংরো প্যয়ে, (রাঙা পুষ্প শোভিত এ মাসে আত্মহারা হয় সাংগ্রের আনন্দে এই শুভ দিনে তুলনাহীন তুমি, পেন্ডেলে বসে স্বাগত জ্বানাও, সাংগ্রেং-এর জল হীম শীতল সুন্দরী তুমি অপূর্ব) শহরের অলিতে-গলিতে এই ধরনের গান গেয়ে আদিবাসীরা এক অপরকে পানিবর্ষণ করে জলকেলি বা পানি উৎসবে মেতে ওঠে।
এক একজন তরুণ একজন তরুণীর দেহে জল ছিটায়। আর ঐ তরুণীও ঐ তরুণের দেহে পাল্টা জল ছিটিয়ে তার প্রতি উত্তর দেয়। এভাবে তরুণ-তরুণীদের পানি ছিটানো দিয়ে খেলার মাধ্যমে পানি খেলা উৎসব উদযাপিত হয়। আগামী ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিহারে সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে এই উৎসবের।
মোহাম্মদ আলী রাঙ্গামাটি থেকে জানান, রাঙ্গামাটিতে বর্ণিল নানা আয়োজন ও পাহাড়ী-বাঙালীর মিলন মেলার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু পালিত হয়েছে। পাহাড়ীদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি ও রাঙালীদের বৈশাখী উৎসবকে ঘিরে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় তিন দিনব্যাপী সরকারী ও বেসরকারীভাবে বর্ণাঢ্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠান তিন দিনের হলেও মূলত এটা চলছে সপ্তাহব্যাপী। মূল বিজুর প্রধান আর্কষণ হলো অতিথিদের মাঝে পাহাড়ীদের ঐহিত্যবাহী খাবার ‘পাঁচন’ পরিবেশন করা। আর একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে বয়োজেষ্ঠ্যদের প্রণাম করা। এই দিন যুবক যুবতীরা দল বেঁধে একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব তার চিরায়ত ব্যঞ্জনায় রূপ লাভ করে। বহু প্রকার সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই পাঁচন তৈরি করা হয়। যা অত্যন্ত সুসাধু এবং পাহাড়ী বাঙালী সকলের জন্য অত্যন্ত প্রিয় খাবার। পাহাড়ীদের বিশ্বাস, এই পাঁচন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া একদিনে সাত পরিবারে এই পাঁচন খেলে সর্বরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় বলে তাদের ধারণা। বিজুর দিনে পাহাড়ীদের বাসায় পাহাড়ী-বাঙালী সবাই যায়। এদিন ফুটে এঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মনোভাব। এই উৎসব ৩ দিনের হলেও এটি চলে সপ্তাহব্যাপী। রাঙ্গামাটিতে এই উৎসব শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মিলনায়তনে বৈসাবি মেলা দিয়ে। এছাড়া বৈসাবি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন শহরে তাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা করে দিন কাটায়। পাহাড়ীদের বিজু অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পালন করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শনিবার রাঙ্গামাটিতে সরকারী ও নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচী পালন করবে। ওইদিন শহরে পাহাড়ী বাঙালী মিলে একটি আনন্দ মিছিল বের করা হবে। মিছিলটি পৌরসভা থেকে শুরু হয়ে জেলা প্রশাসনের কার্যালয় প্রঙ্গণে গিয়ে শেষ হবে।