ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁসার সামগ্রী

ঐতিহ্যের সামগ্রী- টিকে আছে কোন রকম, আজও ব্যবহৃত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৯ এপ্রিল ২০১৮

ঐতিহ্যের সামগ্রী- টিকে আছে কোন রকম, আজও ব্যবহৃত হচ্ছে

সমুদ্র হক ।। নিকট অতীতে চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ বরণে কাঁসার থালা-বাটি গ্লাসের ও পাত্রের কদর ছিল। বৈশাখের আগের রাতে এগুলো মেজে ঝকঝকে করা হতো। বছরের প্রথম দিনে কাঁসার থালায় খাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। প্রাচীন ইতিহাসের ধারায় কাঁসার বাসন-কোসন সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। বাঙালীর ঐতিহ্যের এই কাঁসার কদর আজ আর তেমন নেই। তবু টিকে আছে। আজও অনেক পরিবার খাবার টেবিলে কাঁসার থালা ও গ্লাস ব্যবহার করে। বগুড়ার কাঁসা শিল্পী আনন্দ চন্দ্র দাস বললেন, আজও অনেকে কাঁসার সামগ্রী ব্যবহার করেন। তবে আগের মতো নয়। দাম একটু বেশি। প্রতি কেজি কাঁসার সামগ্রী বিক্রি হয় গ্লাস ১ হাজার ৮শ’ টাকা কেজি দরে। থালা ১ হাজার ৫শ’ টাকা কেজি দরে। সাধারণত অঘ্রান থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত ও বিয়ে শাদীতে কাঁসার সামগ্রী বেশি বিক্রি হয়। বর্তমান প্রজন্ম কাঁসার জিনিসপত্র হয়তো দেখেই নি। প্রবীণ আজ যারা ও মধ্য বয়সী প্রত্যেকের ঘরে ছিল কাঁসার থালা, বাটি, জগ, গ্লাস, পাতিল, গামলা, কলসি, বালতি, পানদানিসহ নানা কিছু। এমনকী ইঁদারা ও কুয়ার ধারে কাঁসার বদনা ব্যবহার হতো। বনেদি ও বড় গেরস্ত ঘরে প্রত্যেকের খাবার জন্য আলাদা করে কাঁসার থালা ছিল। বাড়ির কর্তার থালাটি ছিল একটু বড়। কাঁসার এসব সামগ্রীর কোন কোনটির ওপর থাকত বাহারি নক্সা। কেউ নাম লিখে নিত। আগের দিনের বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানে কাঁসার জিনিসপত্র উপহার দেয়া ছিল রেওয়াজ। শিল্পের মর্যাদায় কাঁসার তৈজসপত্র ছিল ওপরে। কাঁসা শিল্পীদেরও ছিল নাম ডাক। কে কত নিখুঁত ও ঝকঝকে কাঁসার বাসন বানাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, কয়েক হাজার বছর আগে কয়েক সভ্যতা জুড়ে রয়েছে এই কাঁসা শিল্প। প্রতœতত্ত্ব¡বিদরা দেশের অনেক স্থানে খনন করে কাঁসার সামগ্রী পাচ্ছেন। টাঙ্গাইল ও ঢাকার ধামরাই ছিল কাঁসা শিল্পের সূতিকাগার। কাঁসা সামগ্রী রফতানি হতো বিদেশে। সুন্দর কারুকাজ, নান্দনিক ও গুণগত মানে কাঁসার জিনিসপত্র দেখে মগ্ধ হয় ব্রিটিশরা। তারা কাঁসা শিল্পীদের প্রশংসা করে পুরস্কার ও পদক দিয়েছিল। যারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাদের বংশধরের অনেকে টাঙ্গাইলের কাগমারী, মগড়া, সাকরাইল গ্রামে কাঁসা শিল্পের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন। অনেকে ভারতে চলে গেছেন। কেউ পেশা বদলেছেন। ইতিহাস বলে, রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে উপমহাদেশে ভারতের কংস বণিকদের মাধ্যমে এই দেশে কাঁসা শিল্পের প্রচলন ঘটে। সেই হিসেবে কংস বণিকরাই কাঁসা শিল্পের উদ্ভাবক। একটা সকল কাঁসা শিল্প ছিল জীবন যাপনের অংশ। সকল আচার অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়িয়ে দিত কাঁসার ব্যবহার। এরপর পিতল ও তামার ব্যবহার শুরু হয়। এখন পর্যন্ত কাঁসা তামা পিতল দিয়ে ছোট বড় ভাস্কর্য ধামরাইতে বানানো হচ্ছে। রথ যাত্রার ওপরও বড় ভাস্কর্য বানিয়েছে ধামরাইয়ের কাঁসা শিল্পীরা। কাঁসা পিতল তামার তৈজসপত্রসহ নানা ধরনের শো পিস বানান হচ্ছে। টাঙ্গাইল ধামরাই ঢাকা মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর মানিকগঞ্জ নরসিংদী পাবনা ছিল কাঁসার জিনিসপত্রের অন্যতম পরিচিত এলাকা। ৭০ দশকের মধ্যভাগে কাঁসা শিল্পের ওপর প্রথম আঘাত করে সিরামিক। সিরামিকের থালা বাটি গ্লাস কাপ পিরিচ জগ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ বিত্তের ঘরে প্রবেশ করে। এরপর ডিনার সেট টি-সেটসহ বিশেষ ধরনের সিরামিক সামগ্রীতে ভরে যায় প্রতিটি এলাকা। এর মধ্যেই আশির দশকে সিরামিকের সঙ্গে পাল্লায় নামে মেলামাইনের বাসন-কোসন। রকমারি ও নজর কাড়া ডিজাইনে সিরামিক মেলামাইন ঘরে ঘরে প্রবেশ করে কাঁসাকে হটিয়ে দেয়। প্রজন্মের কাছে কাঁসার বাসন কোসন হয়ে পড়ে অচেনা। কালেভদ্রে কোন বাড়িতে কাঁসার জিনিস বের করে প্রজন্মের কাছে বাড়ির লোকজন বর্ণনা দেয়, এই থালায় বা এই বাটিতে তার পূর্ব পুরুষ আহার করতেন। আজও প্রবীণ অনেকের ঘরে অযতনে হয়তো পড়ে আছে কাঁসার ওসব তৈজসপত্র। কাঁসার নির্বাসনে কাঁসা শিল্পীর জীবন টিকে আছে কোন রকমে। একজন কাঁসা শিল্পী বললেন, থালা বাটি কলসি আর কেউ বানায় না। প্রদীপ মোমদানি চিলিমচি সৌন্দর্যবর্ধক কোন জিনিস কেউ বানিয়ে নেয়। কাঁসার জিনিস বানিয়ে তেমন লাভ নেই। বেশি দরে কাঁচামাল কিনে জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে কতই বা লাভ হয়। কাঁসা এক ধরনের ধাতু। বিগলন ঢালাই প্রযুক্তির মাধ্যমে জিনিস বানাতে হয়। দরকার হয় বিশেষ ধরনের ছাঁচের। এগুলো এখন সহজে মেলে না। ভাস্কর্য তৈরি পদ্ধতিও আলাদা। মোম দিয়ে অবয়বের পর নক্সা ও সূক্ষ্ম কারুকাজ করে দিতে হয় তিন স্তরের মাটির প্রলেপ। তারপর পুড়িয়ে মোম গলে মাটির ছাঁচে লেগে যায়। গলানো কাঁসা সেই ছাঁচে ঢুকিয়ে তৈরি হয় নক্সা ভাস্কর্য। ঐতিহ্য ধরে রাখতে শৌখিন লোকজনই কাঁসা কেনে। তবু এভাবেই যত দিন টিকে থাকে। খুব বেশি দূরে হয়তো নয়, যেদিন কাঁসা এ্যান্টিকসের খাতায় নাম লিখিয়ে দৃশ্যমান হবে কোন জাদুঘরে ও অতি প্রবীণ কোন মানুষের কুটিরে।
×