ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দগ্ধ তিনজন ॥ এলাকায় আতঙ্ক ॥ তদন্ত কমিটি গঠন

ভালুকায় ৬তলা ভবনে বিস্ফোরণ ॥ কুয়েট ছাত্র নিহত

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৬ মার্চ ২০১৮

ভালুকায় ৬তলা ভবনে বিস্ফোরণ ॥ কুয়েট ছাত্র নিহত

বাবুল হোসেন, ভালুকা থেকে ফিরে ॥ ভালুকার ৬ তলা একটি ভবনের ৩য় তলায় শনিবার মধ্যরাতে শক্তিশালী বিস্ফোরণে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম নিহত ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৩ ছাত্র দগ্ধ হয়েছেন। নিহত তৌহিদুল সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের মনিরুল ইসলামের পুত্র। গুরুতর দগ্ধ ৩ জনকে শনিবার রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হচ্ছে- নওগাঁর নান্দাইলপুর গ্রামের বেলালের পুত্র হাফিজ উদ্দিন, মাগুরার দীগরসালিকা গ্রামের বিমল সরকারের পুত্র দীপ্ত সরকার ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের নুরুল ইসলাম আকন্দের পুত্র শাহীন আকন্দ। হতাহতরা ইন্টার্ন করার জন্য ভালুকার ওই ভবনের একটি ফ্ল্যাট চলতি মার্চ মাসে ভাড়া নিয়েছিল। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম শনিবার রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, হতাহতদের ফ্ল্যাটে কোন গ্যাস সংযোগ কিংবা বার্নার ছিল না। আর স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে এত ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। এদিকে ঘটনা তদন্তে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে আলাদা ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে রবিবার দুপুরে ঢাকা থেকে মেজর মাহমুদের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে আসেন আট সদস্যের বোমা ডিসপোজাল দল। খবর পেয়ে রবিবার সকালে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন ও ডিআইজি-ময়মনসিংহ রেঞ্জ নিবাস চন্দ্র মাঝিসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনার পর থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত বাড়িটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী। পরে অবশ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শনিবার রাতের ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন বাড়ি মালিক। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ভালুকার বিএনপিপন্থী স্থানীয় ঝুট ব্যবসায়ী হাজী আব্দুর রাজ্জাক ঢালীর মালিকানাধীন ৬ তলা ভবনটির ৩য় তলার মাঝ সারির একটি ফ্ল্যাটের পেছনের দিকে ৩টি রুম গত ১০ দিন আগে এক মাসের জন্য ভাড়া নেয় খুলনা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্র। ভালুকার মাস্টারবাড়ি এলাকায় স্কয়ার ফ্যাশন টেক্সটাইল মিলে ওই চার ছাত্র ইন্টার্ন করার কথা বলেই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়। ৬ তলা নতুন ভবনটিতে ৫৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ওই চার ছাত্র ছাড়াও আরও ৫টি পরিবার ভাড়া থাকত। শনিবার রাত সাড়ে ১২ টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো ভালুকা। মধ্যরাতে এমন বিকট শব্দে জেগে উঠে আশপাশের বাসিন্দারাও। ভবনটির চারতলার ভাড়াটিয়া তৌহিদা সিদ্দিকা ও আবুবকর সিদ্দিক জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে ঝনঝন শব্দে পুরো ভবনের কাচ টুকরো হয়ে চারপাশে ঝরে পড়ছে। সিটকে পড়ছে ভবনের বারান্দার চারপাশের গ্রীল। ফ্ল্যাটের ভেতরের দরজা জানালাসহ আসবাবপত্রগুলো দুমড়ে মুচড়ে ঘুর্ণিপাক খাচ্ছে। ধসে পড়ছে বেডরুমের চারপাশের দেয়াল। কোন কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোন মতে বের হয়ে আসেন চারতলার ফ্ল্যাট থেকে। নামার সময় সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ ও র‌্যাব এসে বাড়িটি ঘিরে রাখে। তয়তলার ভাড়াটিয়া শামীমা জানান, বিকট শব্দের উৎসস্থলের পাশের ফ্ল্যাটেই দুই সন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় বেশ কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে দেখেছেন। ঘটনার পর রবিবার দুপুরে গিয়ে দেখেন তার ঘরে রাখা ল্যাপটপটি নেই। ভবনটির সামনেই বাস এক যুবক জানান, কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও শব্দটি শোনা গেছে। তিনি ঘুম থেকে জেগে বাইরে এসে দগ্ধ বেশ কয়েকজনকে দৌড়ে যেতে দেখেছেন। রবিবার দুপুরে ভালুকার জামিরদিয়া আইডিয়াল মোড়ের আরএস টাওয়ার ইউনিট-২ নামের ৬ তলা ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো ভবনটি বিধ্বস্ত। ভবনটি চারপাশে কাচের কোন জানালাই অক্ষত নেই। ভাঙ্গা কাচের টুকরো সিটকে পড়েছে ভবনের চারপাশে ২০-৫০ মিটার দূরে। ভবনের ৩য় তলার সামনের অংশের লোহার এঙ্গেলের বারান্দার একটি গ্রীল খুলে গিয়ে সিটকে পড়ে আছে ২০ মিটার দূরে। ভবনটির ৩য় তলার পেছনের ২টি কক্ষের পুরো দেয়াল ধসে গিয়ে পড়েছে পাশের বস্তির ছাপড়া ঘরে। তবে ছাপড়া ঘরের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভবনের ৩য় তলার মেঝ সারির চার ছাত্রের ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটের ৩টি কক্ষই বিধ্বস্ত। পেছনের কক্ষের দুটি দেয়াল উড়ে গেছে। মাঝখানের কক্ষের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে চার জোড়া শো-জোতা জোড়াসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আর সামনে কক্ষের দুটি দেয়ালই ধসে পড়েছে। আরেকটিতে মারাত্মক ফাটল। পুরো মেঝজুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। পাশের ফাটল দেয়ালসহ বাথরুমের দেয়ালেও লেগে আছে রক্তের দাগ। এই কক্ষেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ল্যাপটপের ব্যাগ, চার্জার, মাউসসহ কিছু বইপত্র, ট্রাভেল ব্যাগ ও জামাকাপড়। পুলিশের ধারণা এই কক্ষ থেকেই বিকট শব্দের উৎপত্তি। নিহত তৌহিদুলের লাশ এখান থেকেই উদ্ধার করে পুলিশ। রক্তের আলামত দেখে স্থানীয়দের ধারণা হতাহত চারজন এখানেই একসঙ্গে অবস্থান করছিল। অথচ এই ফ্ল্যাটের ভেতর গ্যাস সংযোগ কিংবা রান্নাঘরে কোন বার্নার দেখা যায়নি। ভবনটির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গিয়েও দেখা গেছে একই চিত্র। লোহার স্টিলের দরজা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। জানালার ফ্রেম ও বারান্দা থেকে লোহার গ্রীল আলাদা হয়ে সিটকে বাইরে পড়েছে। তবে কয়েকটি ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে গ্যাসের চুলা দেখা গেছে। ভবনটিতেও রয়েছে গ্যাসের পাইপ লাইন। ভালুকা উপজেলা তিতাস কর্মকর্তা ডেপুটি ম্যানেজার প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম জানান ভবনটিতে অনুমোদিত কোন গ্যাস সংযোগ নেই তিতাসের। গ্যাস লাইন ফেটে কিংবা গ্যাস বিস্ফোরণে কোন ভবনের এতবড় দুর্ঘটনা নজিরবিহীন বলে দাবি করেন তিতাসের এই কর্মকর্তা। ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক খানে আলম খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে এত ভয়াবহ ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। এছাড়া ওই ফ্ল্যাটের কোথাও গ্যাস লাইন ফাটা কিংবা লিকেজ দেখা যায়নি-যা থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তদন্তের পরই জানা যাবে আসল রহস্য, জানালেন এই কর্মকর্তা। ডিআইজি ময়মনসিংহ রেঞ্জ নিবাস চন্দ্র মাঝি রবিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, বড় ধরনের এই বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা হবে। বোমা ডিজপোজাল দলও এর কারণ খতিয়ে দেখছে বলে জানান তিনি। যদিও এর আগে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার শনিবার রাতে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান, বাথরুমের গ্যাস কিংবা গ্যাস সংযোগের বিস্ফোরণ থেকে এই হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। বোমা ডিজপোজাল দলের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, বিস্ফোরণে বোমার কোন আলামত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে গ্যাস থেকেই এই বিস্ফোরণ বলে ধারণা করছে বোমা ডিজপোজাল দলের কর্মকর্তারা। দগ্ধদের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক ॥ বিস্ফোরণে মারাত্মক দগ্ধ শাহীন আকন্দকে ভালুকা থেকে সরাসরি ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দীপ্ত সরকার ও হাফিজকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শনিবার রাতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রবিবার ভোর ৪টার দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদেরকেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এসময় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সুনন্দ সেন জানান, হাফিজের শরীরের ৫৫ শতাংশ এবং দীপ্ত এর শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এই পার্সেনটিজ আশঙ্কাজনক। আলাদা তদন্ত কমিটি ॥ বিকট শব্দে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ড. সুভাস চন্দ্র বিশ্বাস এবং পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামের নির্দেশে আলাদা ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাইরোজ্জামানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের এবং পুলিশ প্রশাসনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক্রাইম এসএ নেওয়াজীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরিবারে কাছে লাশ হস্তাস্তর॥ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত তৌহিদুল ইসলামের লাশ রবিবার বিকেলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ তৌহিদুলের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। লাশ গ্রহণের সময় তৌহিদুলের পরিবারের সদস্য ও তার স্বজনেরা ভালুকা থানায় উপস্থিত ছিলেন। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি ॥ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় ভালুকা মডেল থানা পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মামলায় বাড়ি মালিক হাজী আব্দুর রাজ্জাক ঢালীকে আসামি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। রবিবার পর্যন্ত এই ঘটনায় কাউকে আটক কিংবা গ্রেফতার করা যায়নি। কুয়েট ভিসির শোক ॥ খুলনা অফিস জানায়, ময়মনসিংহের ভালুকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের হতাহতের ঘটনায় শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর। এক বিবৃতিতে কুয়েট ভাইস-চ্যান্সেলর নিহতের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
×