ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিধান্বিত মুসলিম বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে টানার চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৪ মার্চ ২০১৮

 দ্বিধান্বিত মুসলিম বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে টানার চেষ্টা

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্তির মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অধিকাংশই সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। আবার কেউ কেউ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। ভারত-ইসরাইলের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে বলে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা বার্তা ছড়িয়ে দেয় পাকিস্তান। সে কারণে মুসলিম ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য অধিকাংশ মুসলিম দেশ পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। আর মুসলিম দেশগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার জন্য প্রবাসী সরকার কূটনৈতিক যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তিনদিন পরেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ওআইসির তৎকালীন মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে পাকিস্তানের একান্তই অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। আর ভারতের উদ্দেশে তিনি বলেন, পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বাইরের কোন দেশের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। ওআইসি মহাসচিবের এই বিবৃতিকে পরবর্তীতে সমর্থন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সৌদি আরব। মুক্তিযুদ্ধের সময় তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান, জর্দান ও লিবিয়া প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করে। আর পরোক্ষভাবে কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্কো পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, সুদান, আলজিরিয়া নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের কথা বলে পাকিস্তান মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অপপ্রচার চালিয়েছিল। পাকিস্তান সকল মুসলিম দেশকে বুঝিয়েছিল ভারতের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গনের ষড়যন্ত্র চলছে। সে কারণে অধিকাংশই মুসলিম দেশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সে সময় আমি জেনেভায় কর্মরত ছিলাম। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে শুধু মিসর ও ইরাকের সহযোগিতা পাওয়া যায়। এই দুটি দেশ ছাড়া অন্য মুসলিম দেশের সহযোগিতা তেমন পাইনি বলেও জানান তিনি। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে মুসলিম বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার চেষ্টা চলছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যেসব রাষ্ট্র কোন অবস্থান নেননি অথবা দোদুল্যমান কিংবা বিরোধিতা করছেন, তাদের আমি আশ্বস্ত করতে চাই, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যয়দীপ্ত আকাক্সক্ষার প্রতিফলন বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে উড্ডীন হয়েছে তা সমুন্নত থাকবে। তিনি আরও বলেন, এটা হবে একটি ট্র্যাজিক ভ্রান্তি যেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খানের এই যুদ্ধকে তারা ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক বলে মনে করবেন। দাসত্ব ও বর্বরতাকে না দেখার ভান করেও নীরব রয়েছেন। তারা তাদের নৈতিকতাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।’ ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বকে এক কাতারে আনার জন্য ওআইসি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৬৯ সালে ওআইসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওআইসির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তান। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান ওআইসি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত-ইসরাইলের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গতে চায় বলে এমন অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল। আর এই কাজে পাকিস্তান প্রথম দিকে বেশ সফলও হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের গণহত্যার চিত্র ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লে, পাকিস্তানের ভিত নড়ে যায়। মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন পেতে মুজিবনগর সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বৈরুত, দামেস্ক, বাগদাদ, তেহরান, ইস্তান্বুল, আঙ্কারা, কায়রো প্রভৃতি মিশনে বাংলাদেশী দূত নিযুক্ত করা হয়। এসব দূতদের সকলেই পাকিস্তানের বিভিন্ন মিশন থেকে পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেন।
×