ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হোলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনাকারী সাগর ও নিলয় গ্রেফতারের পর তথ্য

গত বছর ১৫ আগস্ট শীর্ষ নেতাদের হত্যার ছক কষেছিল জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৩ মার্চ ২০১৮

গত বছর ১৫ আগস্ট শীর্ষ নেতাদের হত্যার ছক কষেছিল জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ শতাধিক মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করেছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী হাসিদুর রহমান সাগর ও রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও-তে আত্মঘাতী জঙ্গী বিস্ফোরণ ঘটানোর অর্থ যোগানদাতা আকরাম হোসেন নিলয়কে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেছে তারা। বগুড়ায় এই দুই জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে সাতদিনের হেফাজতে নিয়েছে গুলশান হামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। এর আগে নব্য জেএমবির এই দুই ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ জঙ্গী নেতা হাদিসুর রহমান সাগর ও আকরাম হোসেন নিলয়কে বুধবার পুলিশ বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে হস্তান্তর করে। এরপর বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে পাঠিয়ে সাতদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় অন্যতম পরিকল্পনাকারী সন্দেহভাজন পলাতক আসামি হাদিসুর রহমান সাগর। সে ওই হামলার ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল বলে পুলিশ তাদের অনুসন্ধানে জানতে পারে। সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য। ২০১৪-১৫ সালে তামিম চৌধুরীর হাত ধরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয় সে। নব্য জেএমবিতে সে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবেও পরিচিত ছিল। মাসখানেক আগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রেফতার হওয়া আকরাম হোসেন নিলয় নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ একজন অর্থদাতা। গুলশান হামলার পর থেকে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সে। সংগঠনে ‘স্পেড উইলসন’ এবং ‘জ্যাক স্পেরো’ নামেও পরিচিত ছিল সে। এর আগে গত বছরের নবেম্বর মাসে নিলয়ের বাবা আবু তোরাব এবং মা ও বোনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। নিলয় ও তার পরিবারকে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডের জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ ও মাল্যদান উপলক্ষে জমায়েত হওয়া মন্ত্রী, এমপিসহ শত শত জড়ো হওয়া মানুষজনের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল গ্রেফতার হওয়া সাগর ও নিলয়ের নেতৃত্বে জঙ্গীরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ আগস্টের আগে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও-তে অবস্থান নেয় নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য সাইফুলের পরিকল্পনায় ছিল যে কোন উপায়ে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো। এজন্য বেশ বড় আকারের একটি বোমা তৈরি করে সাইফুলের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল তার সহযোগী জঙ্গীরা। এই ঘটনায় বোমা তৈরির কারিগর এবং অর্থ সরবরাহকারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম- সিটিটিসি ইউনিট। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সর্বশেষ মোহাম্মদ তাজুল ওরফে ছোটন নামে এক জঙ্গীকে গত ১৬ মার্চ গ্রেফতারের পর তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিটিটিসি। আর বুধবার বগুড়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে সাগর ও নিলয়কে। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিটিটিসির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ আগস্ট ধানম-ির ৩২নং রোডের জাদুঘরে হামলার আগেই সিটিটিসির অভিযানে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয় জঙ্গী সাইফুল। ওই ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারা, কেন এবং কী উদ্দেশ্যে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল, তার পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। এমনকি কারা অর্থ সরবরাহ করেছিল, তাও জানা গেছে। ইতোমধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল কক্ষের আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার ঘটনার তদন্তের শেষ পর্যায়ে এসে গ্রেফতার হয় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী দুর্ধর্ষ জঙ্গী সাগর ও পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার অর্থ যোগানদাতা নিলয়। এই দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গীর নেতৃত্বেই গত ১৫ আগস্টে ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাদুঘরে জাতীয় শোক দিবসে সমবেত হওয়া মন্ত্রী, এমপিসহ শতাধিক মানুষজনকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা দুই জনেই আবার নতুন করে নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনটি সংগঠিত করছিল বলে সিটিটিসির দাবি। সিটিটিসির সূত্র জানান, বুধবার রাত দেড়টার দিকে শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক থেকে সাগর ও নিলয়কে গ্রেফতার করা হয়। তারা অন্য কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে কিচক বাজারে অবস্থান করছিলেন। দুই জঙ্গীই হাইপ্রোফাইল জঙ্গী। তাদের গ্রেফতারের খবর কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে (সিটিটিসি) জানানো হয়। সিটিটিসির নির্দেশে তাদের বুধবার রাতেই ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় আনার পর গুলশান হামলার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নিয়ে যান সাগরকে। ১০ দিন পুলিশ হেফাজতের আবেদনও আদালতের কাছে করেন তিনি। মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম শুনানি নিয়ে সাতদিন হেফাজতের আদেশ দেন বলে জানা গেছে। সাগরকে নিয়ে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার মামলায় এই পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। হামলায় জড়িত যাদের বিভিন্ন অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘রাজীব গান্ধী’, রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, রাকিবুল হাসান রিগান, সোহেল মাহফুজ। হলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র হামলাকারী পাঁচজনই কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছিলেন। এছাড়া সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে তামিম চৌধুরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, ছোট মিজানসহ কয়েকজন মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকেও এই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এখনও কারাগারে রয়েছেন। তবে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কিছু বলেনি পুলিশ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসীরা হামলা কয়েকজনকে জিম্মি করে রাখে। এ সময় অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন। ওই রাতে বিভিন্ন সময় তিন বাংলাদেশীসহ ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে জঙ্গীরা। ওই ঘটনায় ওই বছরের ২ জুলাই সকালে যৌথ বাহিনী কমান্ডো অভিযান চালায়। এতে ছয় হামলাকারী নিহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৩ জিম্মিকে। পরে ৪ জুলাই নিহত ৫ জঙ্গীসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। দুই বছর আগে ’১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যার এই মামলায় অভিযোগপত্র এখনও জমা পড়েনি। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার অস্ত্র, বিস্ফোরক সরবরাহকারী ও অন্যতম পরিকল্পনাকারী হাদিসুর রহমান সাগর ধরা পড়ায় এই মামলার চার্জশীট দিতে বিলম্ব হতে পারে বলে সিটিটিসির দাবি। কে এই সাগর ॥ হাদিসুর রহমান সাগর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত জঙ্গীনেতা নুরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি। রাশেদসহ গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ জঙ্গীদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে সাগরের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য পেলেও ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে তাকে এতদিন ধরতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। জঙ্গী সাগর অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সংগঠনের কাউকে কোন সঠিক তথ্য দিত না। যোগাযোগ রক্ষার এ্যাপস ব্যবহারেও বিশ্বাসী নয় সে। তাই সাংগঠনিক কাজে সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে এই জঙ্গী নেতা এখনও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজশাহীতে সাগরের সহযোগী হিসেবে যারা জেএমবিতে এসেছে তাদের অনেকে আগে শিবিরের কর্মী ছিল। ধূর্ত এই জঙ্গীর প্রকৃত নাম হাদিসুর রহমান, সাগর তার সাংগঠনিক নাম। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আরেক পরিকল্পনাকারী নূরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি এই সাগর। মারজানের বাড়ি পাবনায় হলেও তারা কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকায় থাকত। এই সুবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঝিনাইদহে তার যাতায়াত ছিল। গুলশান হামলার আগে ঝিনাইদহে থাকা জঙ্গীদের আস্তানায় গিয়েছিল সাগর। সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য ছিল। ২০১৪ সালে সে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির শুরা সদস্য মনোনীত হয়। দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলে। ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের কাজ করত সে। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো রাশেদ ও ছোট মিজানের কাছে দেয় গ্রেফতার হওয়া দুর্ধর্ষ এই জঙ্গী সাগরই। সিটিটিসির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জঙ্গী হামলা করা হবে এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনায় নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে আত্মঘাতী এক জঙ্গী অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে হোটেলটি ঘেরাও করে রাখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসি। পরে সিটিটিসির সোয়াট টিমের সদস্যরা অভিযান চালাতে গেলে আত্মঘাতী জঙ্গী দলের সদস্য সাইফুল ইসলাম নিজের কাছে থাকা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সিটিটিসি তাদের এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’। সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশের জঙ্গী বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করে সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধারাবাহিক অভিযানে কোণ্ঠাসা নব্য জেএমবি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বড় হামলার প্রস্তুতি নেয়। এজন্য গত বছরের ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসকে বেছে নিয়েছিল নব্য জেএমবির জঙ্গীরা, যার নেতৃত্বে ছিল সাগর ও নিলয়। যাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা যায়। তাদের টার্গেট ছিল ধানম-ি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যে জানা গেছে, আত্মঘাতী জঙ্গী সদস্য সাইফুল হামলা চালিয়ে শহীদ হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। পরিকল্পনা মতো তিনদিন আগে খুলনা থেকে ঢাকায় আসে সাইফুল। মিরপুরে এক বন্ধুর মেসে একরাত থাকে সে। পরদিন বোমাসহ হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ওঠে। সেখান থেকে ১৫ আগস্ট সকালে ব্যাগ নিয়ে ধানম-ি ৩২ নম্বরে যাওয়ার কথা ছিল তার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন শ্রদ্ধা জানাতে ধানম-ি ৩২ নম্বরে যাবেন, সে সময় গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটনোর জন্য সাইফুলকে বলা হয়েছিল। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের কাছাকাছি গিয়ে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ভিআইপি অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক লোককে হত্যা করা যায়। জঙ্গীদের ধারণা ছিল নেতাকর্মীদের বেশি ভিড়ের কারণে বিস্ফোরণের পর হুড়োহুড়ি বা পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও কিছু লোক মারা যেত। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১৫ আগস্ট শোক দিবসে ভয়াবহ এই হামলার পরিকল্পনাটা ছিল আকরাম হোসেন নিলয় নামে এক শীর্ষ জঙ্গী। নিলয় গত বছরের ১৫ অগাস্ট ঢাকার পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণের ঘটনায় এবং অর্থের যোগানদাতা বলে পুলিশের দাবি। নিলয়ের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, সাগরের বাড়ি জয়পুরহাটে বলে পুলিশ জানিয়েছে। বুধবার রাতে বগুড়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সে। তার সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার অস্ত্র, বিস্ফোরক সরবরাহকারী ও পরিকল্পনাকারী নব্য জেএমবির আরেক জঙ্গী সাগর। জানা যায়, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে শীর্ষ জঙ্গী নেতারা নিহত হলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া নিলয় নব্য জেএমবির হাল ধরে। মূলত সেই আবারও নতুন করে নব্য জেএমবি সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। সাগর ও নিলয়ের সহযোগী, যারা পান্থপথের ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত, তাদেরও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। শোক দিবসে হামলার জন্য যে বোমাটি আনা হয়েছিল, সেটি তৈরি করেছিল নব্য জেএমবির বোমা তৈরির কারিগর মামুন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর উত্তরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। মামুনকে বোমা তৈরির উপকরণ সরবরাহ এবং আশ্রয় দিয়েছিল আইচান কবিরাজ ওরফে রফিক এবং লুলু সরদার নামে দুই জঙ্গী। গত বছরের ১৬ নবেম্বর নওগাঁ থেকে আইচার কবিরাজ এবং লুলু সর্দারসহ পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছিল স্থানীয় পুলিশ। পরে মামুনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইচান ও লুলু কবিরাজকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া, গত বছরের ২২ অক্টোবর শেরপুরের নকলা থেকে আবুল কাশেম ওরফে আবু মুসাব নামে আরেক জঙ্গীকে স্থানীয় থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার পর কোণঠাসা নব্য জেএমবিকে চাঙ্গা করতে আকরাম হোসেন নিলয় যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তার বাবা আবু তোরাব, মা সাদিয়া হোসনা লাকি এবং বোন তাজরীন খানম শুভ্র তা সবকিছুই জানত। নিলয়ের জঙ্গীবাদী কাজে মদদ দেয়া, অর্থের যোগান এবং শোক দিবসে হামলার পরিকল্পনার কথা জেনেও পুলিশকে না জানানোর অভিযোগে গত বছরের ১১ নবেম্বর গুলশান এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া, অর্থ সরবরাহকারী হিসেবে নিলয়ের এক বন্ধু তানভির ইয়াসিন করিমকে গত বছরের ২০ নবেম্বর গ্রেফতার করা হয়। তানভীর নব্য জেএমবিকে নতুন করে সংগঠিত করতে নিলয়কে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল বলে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে। সাগর ও নিলয় গ্রেফতার হওয়ায় রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা ও পান্থপথের বিস্ফোরণসহ নব্য জেএমবির নেপথ্যের তৎপরতার আরও অজানা কাহিনী বের হয়ে আসতে পারে।
×