ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরে কূটনৈতিক যুদ্ধ ১

মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার বিরুদ্ধে নামে পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২০ মার্চ ২০১৮

মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার বিরুদ্ধে নামে পাকিস্তান

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের লক্ষ্যে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার শুরু থেকেই বিশ্ব জনমত গঠনে জোর তৎপরতা শুরু করে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পক্ষে আনতে নানা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত বাঙালী কূটনীতিকরা যেন দ্রুত পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন, সে লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে বাঙালী কূটনীতিকরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। তারা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। সেই সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত বাঙালী কূটনীতিকরা যেন দ্রুত পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন, সেই বিষয়ে বিভিন্ন মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপন আলোচনাও শুরু করা হয়। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই বিভিন্ন দূতাবাসের বাঙালী কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি সফলও হন। তার উদ্যোগেই পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে বাঙালী কূটনীতিকরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভের লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা সফলে প্রবাসী সরকার বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসব উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলা। সেসব দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার ও বিশ্ব জনমত গঠন। পাকিস্তানের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার জবাব। এছাড়া বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ভারত, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। মুজিবনগর সরকার গঠনের দিনই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক ভাষণে পাকিস্তানকে সহযোগিতা না করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র, পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও রেডক্রস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি তাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।...আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে যেন আর অস্ত্র সরবরাহ না করা হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনের পরেই এই সরকারের প্রতিনিধিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তবে প্রবাসী সরকারের কোন প্রতিনিধিই যেন বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে না পারেন, সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিল পাকিস্তান। একাত্তরের এপ্রিলে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ভারতে অবস্থানকারী যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রভাবশালী দেশ হিসেবে এই দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনাকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন তিনি। তবে দিল্লীতে পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনার সাজ্জাদ হায়দার বিষয়টি জানতে পেরে তৎপরতা করেন। সাজ্জাদ হায়দার সেই সময় দিল্লীর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকেও বিষয়টি জানান। কোনক্রমেই যেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাত না হয়, সেজন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান তিনি। একই সঙ্গে ইসলামাবাদ থেকেও তৎপরতা শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি একইভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তৎকালীন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়, মুজিবনগর সরকার একটি অবৈধ সরকার। মুজিবনগর সরকারের কোন প্রতিনিধিই যেন বিশ্বের কোন দেশেই মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক না করতে পারেন, সে লক্ষ্যে মার্কিন প্রশাসন যেন সব ধরনের উদ্যোগ নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের এসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতা চালিয়েছিলেন। আর পাকিস্তানও চেষ্টা চালিয়েছিল মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিরা যেন যোগাযোগ করতে না পারেন, তবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। অনেক মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। এছাড়া সে সময়ে ওয়াশিংটনে কর্মরত আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শাহ এএমএস কিবরিয়ার সঙ্গেও অনেক মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের জেনেভা মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালান।
×