ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনৈক্য না থাকলেও বিএনপিতে এখন তিন ধারা

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৭ মার্চ ২০১৮

 অনৈক্য না থাকলেও বিএনপিতে এখন তিন ধারা

শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী খালেদা জিয়া জামিন না পাওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই বেসামাল অবস্থায় পরিকল্পনা অনুসারে কিছুই করতে পারছে না দলটি। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। এ অবস্থার অবসানে দলটি এখন কী করবে এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। এদিকে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় প্রকাশ্যে বিএনপিতে কোন অনৈক্য দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতরে দলে তিনটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। একটি ধারায় রয়েছেন খালেদা জিয়ার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মধ্য পর্যায়ের কিছু নেতা। এর মধ্যে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ আরও ক’জন রয়েছেন। আরেকটি ধারায় রয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা। আর অপর তিনটি ধারায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও মির্জা আব্বাসসহ ক’জন সিনিয়র নেতা রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে রাজনীতিতে ক্লিনম্যান হিসেবে পরিচিত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন কৌশলে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই দলীয় কর্মকা- পরিচালনার চেষ্টা করছেন। সূত্র মতে, খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেও দলের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব ছাড়েননি, বরং ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেভাবে এ দায়িত্ব নিজের হাতে রেখেছিলেন একইভাবে এবারও নিজের কাছেই চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব রেখে দিয়েছেন। তবে দলের মধ্য পর্যায়ের কিছু নেতা খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার একদিন পরই বিভিন্ন কৌশলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে রাজি করেছেন এবং দলের মুখপাত্রের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। অবশ্য বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের কথা রয়েছে। কিন্তু সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় সাজা ও কোন কোন মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় এবং তিনি এখন বিদেশে অবস্থান করায় তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে পারবেন না ভেবেই খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে দল পরিচালনার দায়িত্ব কৌশলে নিজের হাতে রেখে স্থায়ী কমিটির নেতাদের সমন্বয় কওে বিভিন্ন কর্মকা- চালিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। এ দিকে তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন নেতাদের নিয়ে বিএনপিতে যে ধারা রয়েছে তারা এখন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করায় অন্য দুই ধারার নেতারা দলীয় কর্মসূচী পালনে তেমন সক্রিয় হচ্ছেন না। এ কারণে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত দায়সারা গোছের যে সকল কর্মসূচী দেয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই তেমন সফল হয়নি। আর কিছু নেতা গ্রেফতার এড়ানোর কথা বলে কর্মসূচী থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিএনপিতে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপকে সহ্য করতে না পারায়ই দলে সংস্কারের প্রস্তাব উঠেছিল। আর যারা সেই সংস্কারপন্থী ছিলেন তাদের অধিকাংশ পরে মূল ¯্রােতে প্রবেশ করলেও এখন তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টিকে তারা ভাল চোখে দেখছেন না। এ ছাড়া যে সকল সংস্কারপন্থী নেতারা এখনও দলে থেকে বাইরে আছেন তারা আবার নতুন করে ইস্যু পেয়ে যাচ্ছেন। তাই যে কোন সময় তারা আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে ব্রাকেট বন্দী করতে পারে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও এমন একটি আশঙ্কা থেকেই দলের সিনিয়র নেতাদের বার বার বলে গিয়েছেন দলে যেন কেউ ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত বিএনপিতে ভাঙ্গনের সম্ভাবনা প্রকট না হলেও খালেদা জিয়া জামিন না পেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন অবস্থা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। কারণ, খালেদা জিয়া কারাগারে থেকে আগের মতো আর নির্দেশনা দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে কাজ করতে পারবেন না। আর তারেক রহমানও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন না এবং সুদূর লন্ডনে বসে সঠিকভাবে নির্দেশনা দিয়ে দল পরিচালনা করতে পারবেন না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার তারিখ হওয়ার পর থেকেই তাঁর সাজা হবে বলে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল কীভাবে চলবে এ নিয়ে শুরু হয় নানান কথা। তবে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগেই স্থায়ী কমিটির নেতাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে দল পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে যান। তবে তিনি কারাগারে যাওয়ার পর তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়ায় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র নেতারা দলীয় কর্মকা- নিয়ে আর তেমন বেশি মাথা ঘামান না। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া বেশি দিন কারাগারে থাকলে আর তারেক রহমান বিদেশে থেকে দলের সঠিক নেতৃত্ব দিতে না পারলে সাংগঠনিকভাবে আবার বিএনপি স্থবির হয়ে পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির এক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপিকে এখন নানামুখী সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে খালেদা জিয়ার জামিন হয়ে গেলে দ্রুতই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তা না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ভুল হয়ে গেলে দলের জন্য ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে বিএনপি। তিনি বেশি দিন কারাগারে থাকলে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ সব দলীয় কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার জামিনের অপেক্ষায় বিএনপি। তিনি কখন জামিন পাবেন বা আদৌ পাবেন কী না, আর জামিন পেলেও নির্বাচন করতে পারবেন কী না এ নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই চলছে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে থাকলেও এখনই আন্দোলনের কোন কঠোর কর্মসূচী দিতে পারেনি বিএনপি। অবশ্য খালেদা জিয়া নিজেও চান না কঠোর কর্মসূচী দেয়া হোক। সম্প্রতি বিএনপির ৭ সিনিয়র নেতা কারাগারে দেখা করতে গেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাদের ধৈর্য্য ধরতে বলেন এবং কোন অবস্থাতেই যেন কঠোর কর্মসূচী দেয়া না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করে দেন। তবে খালেদা জিয়ার এ অবস্থানের পর সরকারের দেয়া বিভিন্ন শর্তে সমঝোতা করে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেতে চান বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয় খালেদা জিয়া এ ধরনের কোন সমঝোতার পথে কখনই যাবেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা নাকোচ করে দেয়া হয়। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আপাতত আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামিনের চেষ্টা করার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করবে তারা। তবে শেষ পর্যন্ত জামিন না হলে কিংবা উচ্চ আদালতে মামলার সাজা বহাল থাকলে এক পর্যায়ে কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে বিএনপি। আর এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দফায় দফায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী দিচ্ছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকেই জোরেশোরে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে বিএনপি। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে লিখিত চিঠি দেয়া হয় দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু কূটনৈতিক তৎপরতায় সফলতা পাচ্ছে না বিএনপি। এ দিকে অতীতে রাজপথে নেতিবাচক কর্মসূচী পালন করে বিদেশী কূটনীতিকদের সমর্থন না পাওয়ায় এবার খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও তাকে মুক্ত করতে কঠোর কর্মসূচী দেয়নি বিএনপি। দফায় দফায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে দলের নেতাকর্মীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি সহায়ক সরকারের একটি প্রস্তাব তৈরি করে রাখলেও খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তা ঘোষণা করতে পারছে না। খালেদা জিয়া বেশি দিন কারাগারে থাকলে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব কীভাবে এবং কখন দেয়া হবে এবং দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি কীভাবে এগিয়ে নেয়া হবে সে বিষয়টিও এখন দলের নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করছেন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি এখন নেতাকর্মীদের সামনে উপস্থিত থেকে সরাসরি কোন নির্দেশনা দিতে পারবেন না। এ ছাড়া তারেক রহমানের মাথার ওপরও ১০ বছরের কারাদ- ঝুলে আছে। সহসা তার দেশে ফিরে আসারও কোন সম্ভাবনা নেই। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যাবে। দলীয় যে কোন সিদ্ধান্তের বিষয়ে খালেদা জিয়ার নির্দেশ যেভাবে সর্বসম্মতভাবে মেনে নিয়ে পালন করা হয় সেভাবে অন্য কারও নির্দেশনা পালন হয় কী না এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ, ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই বিএনপি নেতারাই পরষ্পরবিরোধী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দলকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। সূত্র মতে খালেদা জিয়া বেশি দিন কারাগারে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপির জন্য আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে দলে তারেক রহমানের কাছের জন হিসেবে পরিচিত কিছু নেতাকে নিয়ে। কারণ, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। তারা যদি তারেক রহমানের কাছের জন হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন তাহলে সমস্যা দিন দিন বাড়তে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, যে মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠান হয়েছে তা নিয়ে নানামুখী কথাবার্তা হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন শীঘ্রই এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন হবে। আর যদি জামিন না হয় বা তাঁকে বেশি দিন কারাগারে থাকতে হয় তাহলে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে কিছুটা সমস্যা তো হতেই পারে। কারণ, এত বড় একটি রাজনৈতিক দল সঠিকভাবে পরিচালনা করার যে অভিজ্ঞতা খালেদা জিয়ার রয়েছে অন্য কারও তা থাকার কথা নয়।
×